সূচনা:- সৃষ্টির আদি লগ্ন থেকে মানুষ নিজের প্রখর বুদ্ধিমত্তাকে কাজে লাগিয়ে উন্নত থেকে উন্নততর সভ্যতার পথে অগ্রসর হয়েছে । কালের নিয়মে জন্ম নিয়েছে আধুনিক বিজ্ঞান , অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ; জীবন লাভ করেছে এক অনন্য মাত্রা । সভ্যতার জয়যাত্রার পথে মানুষ আজ ভূগর্ভ থেকে মহাকাশ পর্যন্ত পাড়ি দিয়েছে । কিন্তু পাশাপাশি একথাও সত্য যে পৃথিবীর বুকে সভ্যতা যতই জাঁকিয়ে বসেছে , ততই পাল্লা দিয়ে বেড়েছে মানুষের জীবনের নিত্যনতুন চ্যালেঞ্জ । ভিন্ন ভিন্ন যুগে জীবনের এই প্রতিকূলতার রূপও ভিন্ন ভিন্ন । কখনো আঘাত আসে ভূমিকম্প , বন্যা বা খরার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ রূপে ; কখনো বা পৃথিবীর বুকে কোন মহাজাগতিক বস্তু আছড়ে পড়ার আশঙ্কায় মানুষ ভোগে অস্তিত্ব সংকটে ; আবার কখনো সভ্যতার মৃত্যুর পদধ্বনি শোনা যায় কোন মারণরোগ কিংবা মহামারীর আগমনে । বিশ্বব্যাপী প্রাণসংহারী এই মহামারীর তালিকায় নবতম সংযোজন ঘটায় ।
বৈশিষ্ট্য :- একটি নির্দিষ্ট অঞ্চল থেকে এটি বৃহৎ অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে বলে একে এপিডেমিক বা মহামারী নামে আখ্যায়িত করা হয়। ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ এ পর্যবেক্ষিত এই ভাইরাসটির শরীরজুড়ে খাজকাটা অসংখ্য কন্টক একে আপাতভাবে একটি রাজমুকুটের আকার দেয় । এই ভাইরাসটি ভাইরাসগোষ্ঠীর অন্যান্য সদস্যদের তুলনায় আয়তনে বেশ খানিকটা বড় । এটি ডায়ামিটারে ০.০৬ মাইক্রন থেকে ০.১৪ মাইক্রন বা গড়ে ০.১২৫ মাইক্রন পর্যন্ত হয়ে থাকে । করোনাভাইরাস এই পৃথিবীর রোগের দুনিয়ায় নতুন নয় । ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে প্রথম মানুষের শরীরে করোনা ভাইরাসের অস্তিত্ব চিহ্নিত হয় । তারপর থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত মানুষের শরীরে রোগ বহনকারী প্রায় পাঁচ প্রকারের । নোভেল করোনা ভাইরাস ঘটিত রোগটিকে বিশেষজ্ঞরা চিহ্নিত করেছেন কোভিড -১৯ নামে । যার পুরো কথা হল Corona Virus Disease 19 ( COVID - 19 ) .
সংক্রমণের রুপ:- মিউকাস এর মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করে এই ভাইরাসটি বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গকে আক্রমণ করে । এক্ষেত্রেও প্রধান লক্ষ্য হয়ে থাকে মানুষের শ্বাসযন্ত্র । অত্যন্ত ছোঁয়াচে এই ভাইরাসটি প্রধানত মানুষ থেকে মানুষে ছড়িয়ে পড়ে সংক্রমণ ঘটায় ।
সারাবিশ্বে এর প্রভাব:- বিশ্বব্যাপী এই ভাইরাসটির সংক্রমণের কারণ সংক্রান্ত ব্যাপারে আর বিস্তারিত আলোচনার অবকাশ আছে বলে মনে হয় না । কি কি ভাবে এই ভাইরাসটি মানুষ থেকে মানুষে ছড়িয়ে পড়তে পারে সে ব্যাপারে বড় বড় চিকিৎসক থেকে শুরু করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অব্দি কেউই এখনো সম্পূর্ণ নিশ্চিত হতে পারেননি । তবে এই ভাইরাসটির সংক্রমণ বিশেষজ্ঞদের মতে চারটি পর্যায়ে বিভক্ত । প্রথমটি হল , এমন ধরনের মানুষ যারা বিশেষভাবে সংক্রমিত অঞ্চল থেকে সরাসরি সংক্রমিত হয়ে এসেছে । দ্বিতীয় পর্যায়টি হল , যেখানে সরাসরিভাবে সংক্রমিত হওয়া সেই সব মানুষ গুলি নিজেদের সংস্পর্শে আসা অন্যান্য মানুষদের শরীরে ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটায় । তৃতীয় পর্যায়ে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে এক বৃহত্তর অঞ্চল জুড়ে । যার ফলে বিশ্বে হাসপাতালে হাহাকার দেখা গেছে, দেশগুলোতে লকডাউন দেখা দিয়েছে, কলকারখানা সব বন্ধ যার কারণে পরিবেশ সবুজ হয়ে উঠলেও রোজগারহীন মানুষেদের না খেতে পেয়ে দিন কাটাতে হয়েছে।
সামাজিক অবস্থানের পরিবর্তন:- করোনা ভাইরাস মানুষ মানুষের মধ্যে যে দূরত্ব তৈরি করেছে ফলে মানুষের মধ্যে সমাজিকতার মধ্যে প্রাচীর গড়ে দিয়েছে। যেখানে মানুষ বেশি পরিমাণে ব্যাক্তিতান্ত্রিক হয়ে পড়েছে।
পরিত্রাণের উপায়:- কোভিড -১৯ এর নির্দিষ্ট চিকিৎসা বলে কোন কিছু নেই । উপসর্গ অনুযায়ী এর চিকিৎসা হয়ে থাকে । তাই এই ভাইরাস থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় হল ভ্যাক্সিনেশন বা টিকাকরণ এবং প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ । বিশেষজ্ঞদের মতে এই প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা বলতে প্রধানত মানুষে মানুষে সামাজিক বা শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার প্রথাকে বোঝানো হয় । এই নিয়মের পালনের নিমিত্তই বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন দেশের সরকারগুলি দেশ বা নির্দিষ্ট সংক্রমিত অঞ্চল জুড়ে জারি করে লকডাউন । তাছাড়া বিজ্ঞানীরা এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে বারবার বিশেষ ধরনের মাস্কের ব্যবহার এবং হাত পরিষ্কার রাখার উদ্দেশ্যে ৭০ % আইসোপ্রোপাইল অ্যালকোহল দ্বারা তৈরি স্যানিটাইজার তথা সাবান ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছেন । এছাড়াও তারা জানিয়েছেন সংক্রমণ চলাকালীন বিশেষ প্রয়োজন এবং মাস্ক ছাড়া বাড়ির বাইরে বেরোনো সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করতে হবে । তা না হলে করোনাভাইরাস কে প্রতিরোধ করা আমাদের পক্ষে আদৌ সম্ভব হবে না ।
টিকাকরণ কর্মসূচি:- সমগ্র বিশ্বব্যাপী দীর্ঘ গবেষণার পর পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ করোনা ভাইরাসের ভ্যাকসিন বা টিকা আবিষ্কারে সক্ষম হয়েছে । সর্বপ্রথম যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি দল দীর্ঘ গবেষণার পর করোনাভাইরাসের একটি টিকা আবিষ্কার করে তার ট্রায়াল শুরু করে । এর পরবর্তীতে প্রথমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়া ও চীন নিজের স্বদেশে আবিষ্কৃত ভ্যাকসিনের পরীক্ষামূলক প্রয়োগ শুরু করে দেয় । রাশিয়াতে সর্বপ্রথম এই ভ্যাকসিন গ্রহণ করেন রাশিয়ার রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিনের কন্যা । আমাদের উপমহাদেশও ভ্যাকসিন আবিষ্কার এবং তার প্রয়োগের ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকেনি । ভারতের দুটি সংস্থা : সিরাম ইনস্টিটিউট এবং ভারত বায়োটেক দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর ভারতে তৈরি দুটি ভ্যাকসিন নিয়ে আসে । এর একটির নাম হলো কোভিশিল্ড এবং অপরটি ভারত বায়োটেকের তৈরি কোভ্যাক্সিন । প্রথমে পরীক্ষামুলকভাবে এর প্রয়োগ শুরু হয় এবং ট্রায়ালের পর্যায় সফলভাবে শেষ হবার পর ধাপে ধাপে ব্যাপকহারে জনমানসে টিকাকরণ শুরু হয়ে যায় ।
উপসংহার:- সভ্যতা যখন নিজের গতিকে অপ্রতিরোধ্য বলে মনে করে , সৃষ্টি তখন সমগ্র সভ্যতাকে ক্ষণিকের জন্য স্তব্ধ করে দেয় । একটি ক্ষুদ্র আণুবীক্ষণিক ভাইরাস যেন আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে এই প্রবাদ বাক্যের সত্যতাই প্রমাণ করে দিল । আবারো আমরা দেখতে পেলাম সৃষ্টির কাছে আমরা ঠিক কতখানি অসহায় । তবে মানুষের এই অসহায়তায় প্রকৃতি বিশ্বজুড়ে দূষণকে কমিয়ে বায়ুকে আবারো বিশুদ্ধ করে তুলেছে ধীরে ধীরে । লকডাউনে শুনশান হাইওয়েতে বন্য নীলগাইয়ের চরে বেড়ানো এই দুর্যোগের পরিস্থিতিতেও আমাদের মুগ্ধ করেছে । বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে করোনাভাইরাস পরবর্তী পৃথিবী আর আগের মতন থাকবে না । রাজনৈতিক তথা আর্থসামাজিক দিক থেকে এই বিশ্বে হয়তো আমূল পরিবর্তন ঘটে যাবে । মানুষের জীবন যাপনের ক্ষেত্রেও হয়তো আসবে জন্য স্থায়ী পরিবর্তন । তবে একথা সত্যি যে এই দুর্যোগের মেঘ কাটিয়ে উঠে আমরা খুব তাড়াতাড়ি আবার সুস্থ পৃথিবীতে শ্বাস নিতে পারব । নতুন নিয়মের সেই পৃথিবীতে আমাদের সবসময় মনে রাখতে হবে সৃষ্টির সাথে তাল মিলিয়ে সভ্যতার যাপনেই জীবনের প্রকৃত সার্থকতা ।
No comments:
Post a Comment