1.
১৯৪৮ সালের আন্তর্জাতিক রাষ্ট্রবিজ্ঞান সম্মেলনে গৃহীত প্রস্তাব অনুযায়ী রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিষয়সমূহ
প্যারিসের আন্তর্জাতিক রাষ্ট্রবিজ্ঞান সম্মেলনে (১৯৪৮) গৃহীত প্রস্তাব অনুযায়ী রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিষয়গুলি হল一
[1] রাষ্ট্রনৈতিক প্রতিষ্ঠান,
[2] রাজনৈতিক তত্ত্ব,
[3] রাজনৈতিক দল, গােষ্ঠী ও জনমত এবং
[4] আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও আন্তর্জাতিক সংগঠন।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিবর্তন
সামাজিক বিজ্ঞান হিসেবে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একটি স্বতন্ত্র তাৎপর্য রয়েছে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিবর্তন একদিনে হয়নি, প্রায় আড়াই হাজার বছর যাবৎ রাষ্ট্রবিজ্ঞান নতুন চিন্তায় সমৃদ্ধ হয়ে বিবর্তিত হয়ে চলেছে। এই ধারাবাহিকতার আজও কোনাে বিরাম নেই। এই বিবর্তন নিম্নলিখিত পর্যায়ে হয়েছে一
[1] রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সূচনা: রাষ্ট্রবিজ্ঞান হল এক গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক বিজ্ঞান এর চর্চা শুরু হয়েছিল বহুকাল আগে প্রাচীন গ্রিসে রাষ্ট্রচিন্তার দ্বারা আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগে গ্রিসের চিন্তাবিদগণ সফিস্ট (Sophist)-এর সূত্রপাত করেন। পরবর্তীকালে সে যুগের যুক্তিবাদী মনীষী ও সমাজশিক্ষক সক্রেটিস রাষ্ট্রচিন্তার ধারণাকে সত্য ও নীতিজ্ঞানের আলােয় সমৃদ্ধ করতে চেয়েছিলেন। সক্রেটিসের শিষ্য প্লেটো তার দ্য রিপাবলিক (The Republic) গ্রন্থে সফিস্টদের ধ্যানধারণাকে খণ্ডন করে রাজনৈতিক আলােচনায় দর্শন ও নীতিজ্ঞানের প্রাধান্যকে প্রতিষ্ঠিত করেন। পরে রাষ্ট্রতত্ত্বের আলােচনাকে এক সুসংবদ্ধ রূপ দেন অ্যারিস্টটল| তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ পলিটিক্স (Politics) এ তিনি সর্বপ্রথম রাষ্ট্রচিন্তা বা রাজনীতিচর্চাকে বিজ্ঞানের পর্যায়ে উন্নীত করেন। এজন্য অ্যারিস্টট্লকে 'রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক' বলে গণ্য করা হয়।
[2] স্টোয়িক ও রােমান রাষ্ট্রদর্শনের যুগ: প্রাচীন গ্রিক রাষ্ট্রদর্শনের হাত ধরে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের যে সূচনা হয়, তা পরবর্তীকালে স্টোয়িক ও রােমান দার্শনিকদের হাতে সমৃদ্ধ হয়। স্টোয়িক দর্শনে ব্যক্তির স্বাধীন ইচ্ছা ও স্বাতন্ত্র্যকে মর্যাদা দিয়ে এক বিশ্বজনীন আদর্শের কথা প্রচার করা হয়। রােমান রাষ্ট্রচিন্তায় দর্শনের চেয়ে বাস্তবতার বিষয়টি বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। রােমান দার্শনিকরা আইনের শাসন ও শাসনতন্ত্রের প্রাধান্যকে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন।
[3] মধ্যযুগের রাষ্ট্রচিন্তা: মধ্যযুগের রাষ্ট্রচিন্তা একদিকে অস্থিরতা, অন্যদিকে সংস্কারকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান চার্চ ও রাজশক্তির মধ্যে বিরােধকে কেন্দ্র করে এসময় রাষ্ট্রচিন্তায় বিতর্ক দেখা দেয়। খ্রিস্টান যাজকরা রাষ্ট্রের চেয়ে চার্চকে শ্রেষ্ঠ বলে প্রচার করেন। অন্যদিকে, মার্টিন লুথার ও ক্যালভিনের মতাে সংস্কারপন্থীরা ধর্মীয় কুসংস্কার থেকে ব্যক্তিকে মুক্ত করে চার্চের সঙ্গে রাজনীতির সম্পর্ক ছিন্ন করার আহ্বান জানান।
[4] ষােড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীর রাষ্ট্রচিন্তা: মধ্যযুগে ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের বন্টনকে নিয়ে রাজশক্তি ও চার্চের বিরােধের ফলে যে অন্ধকার যুগের সৃষ্টি হয়, তার অবসান ঘটাতে নবজাগরণের পথিকৃৎ নিকোলাে ম্যাকিয়াভেলি আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জন্ম দেন। দার্শনিক হিসেবে তিনিই প্রথম যুক্তিতর্কের সাহায্যে রাজনীতিকে মধ্যযুগীয় ধর্মান্ধতা ও কুসংস্কার থেকে মুক্ত করেন এবং যুক্তিসংগত আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার উন্মেষ ঘটান। দ্য প্রিন্স (The Prince) গ্রন্থে তিনি ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গিকে বাদ দিয়ে যুক্তি ও ভিজ্ঞতার আলােয় শক্তিশালী জাতীয় রাষ্ট্র ও রাজকীয় সার্বভৌম ক্ষমতার তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠা করেন। ম্যাকিয়াভেলির উত্তরসূরি জাঁ বাের্দা ও টমাস হবস নবজাগরণের ভাবধারায় তাদের রচনায় শক্তিশালী রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা তুলে ধরেন।
সপ্তদশ শতাব্দীতে ব্রিটিশ চিন্তাবিদ জন লকের প্রাকৃতিক বা স্বাভাবিক অধিকারের (Natural Rights) তত্ত্ব রাষ্ট্রচিন্তার জগতে এক নতুন যুগের সূচনা করে। জনগণের জীবন, সম্পত্তি ও স্বাধীনতার অধিকার সংরক্ষণের জন্যই রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছে—এ কথা বলে লক উদারনৈতিক মতবাদের সূচনা করেন।
[5] অষ্টাদশ শতাব্দীর রাষ্ট্রচিন্তা: অষ্টাদশ শতাব্দীর রাষ্ট্রচিন্তায় জনগণের সার্বভৌমিকতা, স্বাধীনতা, সাম্য, মৈত্রী এবং গণতান্ত্রিক আদর্শ বাস্তব রূপ লাভ করে আমেরিকার স্বাধীনতা সংগ্রাম (১৭৭৬) ও ফরাসি বিপ্লবের (১৭৮৯) মাধ্যমে। ফরাসি রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রুশাে, ভলতেয়ার, তেষু প্রমুখের রাষ্ট্রচিন্তা আমেরিকা ও ফ্রান্সে উদারনৈতিক গণতন্ত্রের পথে জনগণের শাসন প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করে।
[6] উনবিংশ শতাব্দীর রাষ্ট্রচিন্তা: রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলােচনার ধারায় উনবিংশ শতাব্দী এক নতুন গতির সঞ্চার করে। এসময় একদিকে ভাববাদ, হিতবাদ, উদারনীতিবাদ ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের দর্শন, অন্যদিকে বস্তুবাদী মার্কসীয় দর্শন রাজনীতিচর্চার পরিধিকে আরও সমৃদ্ধ করে। ভাববাদী দর্শন রাষ্ট্রকে একটি ভাব বা আদর্শ হিসেবে প্রচার করে। হিতবাদ, উদারনীতিবাদ ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের ভিত্তিতে গড়ে-ওঠা রাষ্ট্রচিন্তায় প্রচলিত রাষ্ট্রব্যবস্থার মধ্যেই ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ও স্বাধীনতা এবং বজনের হিতসাধনের (কল্যাণের) কথা বলা হয়। অন্যদিকে, মার্কসীয় দর্শন শ্রেণিসংগ্রামের মধ্য দিয়ে এক শােষণহীন, শ্রেণিহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার কথা তুলে ধরে।
[7] বিংশ শতাব্দীর রাষ্ট্রচিন্তা: বিংশ শতাব্দীর গােড়ার দিকে একদল মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রাজনীতিচর্চার ক্ষেত্রে এক নতুন ধারার সূচনা করেন। কোনাে তত্ত্ব বা প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক আলােচনা নয়, রাজনীতিতে ব্যক্তি ও গােষ্ঠীর আচার-আচরণ বিশ্লেষণ করে মূল্যবােধবর্জিত এক বিজ্ঞানসম্মত গবেষণার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন তারা। রাজনীতিচর্চার এই ধারাকে আচরণবাদ বলা হয়। পরবর্তীকালে বিংশ শতাব্দীর ছয়ের দশকের পরে, আচরণবাদের অন্য এক ধারায় 'নয়া আচরণবাদের উদ্ভব ঘটে। নয়া আচরণবাদ রাজনৈতিক বিশ্লেষণে মানবিক চেতনা ও নৈতিক চেতনাকে যুক্ত করে।
বিংশ শতাব্দীর সাতের দশকে নয়া উদারনীতিবাদের জন্ম হয়| নয়া উদারনীতিবাদ রাষ্ট্রের কাজকর্মের পরিধিকে সীমিত করে ব্যক্তিকে সবরকম রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্তি দেয়। নয়া উদারনীতিবাদে ‘মুক্ত বাজার অর্থনীতির কথা বলা হয়। বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে রাজনীতি সম্পর্কিত প্রচলিত ভাবনার কঠোর সমালােচনা করে নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গির পত্তন ঘটে। নারীবাদীরা পুরুষশাসিত সমাজকাঠামাের বদল ঘটিয়ে নারীর অধিকার ও ক্ষমতায়নের জন্য সােচ্চার হন। বিংশ শতাব্দীর নয়ের দশকে নতুন যুগের সামাজিক-অর্থনৈতিক রাজনৈতিক সমস্যাকে কেন্দ্র করে যেসব সামাজিক আন্দোলন গড়ে ওঠে, রাজনীতিচর্চায় সেগুলির গুরুত্বও কম নয়। এদের মধ্যে বিশ্বায়ন সম্পর্কিত বিতর্ক, সন্ত্রাসবাদ বিষয়ক ভাবনা, পরিবেশসচেতনতা আন্দোলন, নাগরিক সমাজের আন্দোলন প্রভৃতি উল্লেখযােগ্য।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায়, রাষ্ট্রবিজ্ঞান একটি গতিশীল বিজ্ঞান। সময়ের বদলের সঙ্গে তাল রেখে আড়াই হাজার বছর ধরে রাষ্ট্রবিজ্ঞান এক গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক বিজ্ঞান হিসেবে নিত্যনতুন ধারায় বিবর্তিত হয়ে চলেছে।