A. বালিয়াড়ি (Sand
Dune): বায়ুপ্রবাহের সঞ্চয়কাজের ফলে যে সমস্ত
ভূমিরূপের সৃষ্টি হয়, বালিয়াড়ি হল তার মধ্যে অন্যতম একটি ভূমিরূপ । বায়ুপ্রবাহের
ক্ষয়কার্যের ফলে শিলাধূলি ও বালির সৃষ্টি হয়, সেগুলি আবার কোথাও কোথাও জমা হয়ে নতুন
ভূমিরূপ গঠন করে । বায়ুপ্রবাহের সঞ্চয়কাজের ফলে কোনো বিস্তীর্ণ স্থান জুড়ে উঁচু ও
দীর্ঘ বালির স্তূপ গঠিত হলে তাকে বালিয়াড়ি বলে । বালিয়াড়ি হল বালির পাহাড় । মরুভূমি
ছাড়া সমুদ্র উপকূলেও বালিয়াড়ি দেখা যায় [যেমন, দিঘা বালিয়াড়ি] । তবে সমুদ্র উপকূলের বালিয়াড়ি সাধারনত
আকারে ছোটো হয় । বাতাসের সঙ্গে সঙ্গে বালিয়াড়ি গতিশীল হয় । বালিয়াড়ি কখনো ভাঙ্গে
আবার কখনো গড়ে, আবার আকৃতির পরিবর্তন ঘটায় । রাজস্থানের
মরুভূমিতে এরূপ চলন্ত বালিয়াড়িকে ধ্রিয়ান বলা হয় ।
বিভিন্ন
প্রকার বালিয়াড়িগুলি হল –
১. বার্খান বালিয়াড়ি (Barkhan Dune) ২. সিফ বালিয়াড়ি (Seif Dune) ৩. নক্ষত্র বালিয়াড়ি (Star
Dune) ৪. অ্যাকলি বালিয়াড়ি (Alkle
Dune) ৫. অধিবৃত্তীয় বালিয়াড়ি (Parabolic
Dune) ৬. উল্টানো বালিয়াড়ি (Reverse
Dune) ৭. দ্রাস বালিয়াড়ি (Drush
Dune) ৮. চুলের কাঁটার ন্যায় বালিয়াড়ি (Hairpin
Dune) ৯. মস্তক বালিয়াড়ি (Head
Dune) ১০. পুচ্ছ বালিয়াড়ি (Tail
Dune) ১১. পার্শ্ব বালিয়াড়ি (Lateral
Dune) ১২. অগ্রবর্তী বালিয়াড়ি (Advanced
Dune) ১৩. পরবর্তী বালিয়াড়ি (Wake
Dune)
ও B. অন্যান্য সঞ্চয় (Other
Depositions): বালিয়াড়ি ছাড়াও আরও কিছু কিছু ভূমিরূপও
বায়ুপ্রবাহের সঞ্চয়কার্যের ফলে সৃষ্টি হয় । এগুলি হল –
১. লোয়েস সমভূমি (Loess Plain) ২. বালি পাত (Sand Sheet) ৩. বালি শিরা (Sand Ridge) ৪. বালি তরঙ্গ (Sand
Ripple)
বার্খান (Barkhan):
☻বুৎপত্তিগত অর্থঃ ‘বার্খান’ একটি তুর্কি শব্দ, এর অর্থ হল “কিরঘিজ
স্টেপস অঞ্চলের বালিয়াড়ি” ।
বার্খান (Barkhan)
সংজ্ঞাঃ উষ্ণ
মরুভূমি অঞ্চলে বায়ুপ্রবাহের গতিপথে বালিয়াড়ি আড়াআড়িভাবে অর্ধচন্দ্রাকারে বিরাজ
করে । এই রকম বালিয়াড়িকে বার্খান বলা হয় । মরু পর্যটক হেডিন সর্বপ্রথম এর নামকরণ করেন ।
উদাঃ সাহারা মরুভূমিতে অনেক বার্খান দেখা যায়
।
বৈশিষ্ট্যঃ বার্খান – এর বৈশিষ্ট্যগুলি হল নিম্নরূপ –
ক) বার্খানের সামনের দিকের ঢাল উত্তল (১০°-১৫°) এবং
পিছনের দিক অবতল (৩০°) আকৃতির হয়ে থাকে ।
খ) বার্খানের দুই প্রান্তে অর্ধচন্দ্রকারে
দুটি শিং – এর মত শিরা অবস্থান করে ।
গ) বার্খান বায়ুর গতির দিকে ক্রমশ ঢালু ও
বিপরীত দিকে ক্রমশ খাঁড়াই হয় ।
ঘ) যে সব মরু অঞ্চলে বছরের বিভিন্ন সময়ে
বিভিন্ন দিক থেকে বায়ু প্রবাহিত হয়, সেখানে বার্খানের সৃষ্টি হয়ে থাকে ।
ঙ) বার্খানগুলির উচ্চতা সাধারণত ১০ – ৩০
মিটার, দৈর্ঘ্য ৫০ – ২০০
মিটার এবং প্রস্থ ৪০ – ৭০ মিটার হয়ে থাকে । তবে অনেকক্ষেত্রে
এরা ২০ – ৩০ মিটার উঁচু এবং ১৪০ মিটার বা তারও
বেশি চওড়া হয় ।
চ) বার্খান মরু অঞ্চলে ল্যান্ডমার্ক হিসাবে
কাজ করে ।
ছ) এগুলি বায়ুর প্রবাহপথে আড়াআড়িভাবে
অবস্থান করে ।
সিফ
বালিয়াড়ি (Seif Dunes):
☻বুৎপত্তিগত অর্থ: ‘সিফ’ একটি আরবী শব্দ, যার অর্থ “সোজা তরবারি”।
সিফ বালিয়াড়ি (Seif Dune)
সংজ্ঞা: তীব্র
ঘূর্ণিবায়ুর আঘাতে পরপর অনেকগুলি বালিয়াড়ি ভেঙ্গে গেলে বায়ুপ্রবাহের
পথে বেশ সংকীর্ণ কিন্তু খুব লম্বা বালিয়াড়ি তৈরি হয় । এই রকম দীর্ঘ অথচ সংকীর্ণ
বালিয়াড়িকে সিফ বালিয়াড়ি (Seif Dunes) বলে । ভূমিরূপ বিজ্ঞানী বার্গনল্ড এর নামকরণ করেন ।
বৈশিষ্ট্যঃ সিফ বালিয়াড়ি – র বৈশিষ্ট্যগুলি হল নিম্নরূপ –
ক) স্থায়ী বালিয়াড়ির মধ্যভাগ বায়ুপ্রবাহের
ফলে ভেঙে সিফ বালিয়াড়ি সৃষ্টি হয় ।
খ) এরকম বালিয়াড়ির উচ্চতা সাধারণত ১০০-২০০
মিটার, দৈর্ঘ্য ১০০-১৫০ কিমি এবং প্রস্থ এক
কিমির মত হয়ে থাকে ।
গ) পরস্পর সমান্তরালভাবে একাধিক সিফ
বালিয়াড়ি গড়ে ওঠে ।
ঘ) এগুলি দেখতে শৈলশিরার মত হয় ।
ঙ) এদের
শীর্ষভাগ ধাঁরালো করাতের মত ও অগ্রভাগ সূচালো হয় ।
চ) দুটি সিফ বালিয়াড়ির মধ্যবর্তী ফাঁককে
করিডোর বলে ।
নক্ষত্র
বালিয়াড়ি (Star Dune):
☻সংজ্ঞাঃ মধ্যভাগে বালির শৃঙ্গবিশিষ্ট ও সেখান
থেকে বিভিন্ন দিকে বালির শৈলশিরা ছড়িয়ে
বালিয়াড়ি নক্ষত্রের ন্যায় রূপ নিলে,
তাকে নক্ষত্র বালিয়াড়ি (Star Dune) বলে ।
নক্ষত্র বালিয়াড়ি (Star Dune)
বৈশিষ্ট্যঃ নক্ষত্র বালিয়াড়ি – র বৈশিষ্ট্যগুলি হল নিম্নরূপ –
ক) বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দিক দিয়ে বায়ু
প্রবাহিত হলে এরূপ বালিয়াড়ি সৃষ্টি হয় ।
খ) এই প্রকার বালিয়াড়িগুলির স্থান পরিবর্তন
একপ্রকার হয় না বললেই চলে ।
গ) এগুলি মরুভূমির ল্যান্ডমার্কহিসাবে ধরা হয় ।
অ্যাকলি
বালিয়াড়ি (Alkle Dune):
☻সংজ্ঞাঃ অনেকগুলি বার্খান বালিয়াড়ি পরস্পরযুক্ত
হয়ে দীর্ঘ সাপের দেহের ন্যায় আকৃতিতে
সারিবদ্ধভাবে
অবস্থান করলে, তাকে অ্যাকলি বালিয়াড়ি (Alkle Dune) বলে ।
অ্যাকলি বালিয়াড়ি (Alkle Dune)
বৈশিষ্ট্যঃ অ্যাকলি বালিয়াড়ি – র বৈশিষ্ট্যগুলি হল নিম্নরূপ –
ক) বছরে দুটি নির্দিষ্ট সময়ে দুটি নির্দিষ্ট
দিক থেকে বায়ু প্রবাহিত হওয়ার ফলে এই প্রকার বালিয়াড়ি সৃষ্টি হয় ।
খ) অ্যাকলি বালিয়াড়ির এগিয়ে যাওয়া বাঁকটিকে লিঙ্গুঅয়েড ও
পিছিয়ে যাওয়া বাঁকটিকে বার্খানঅয়েড বলে
।
অধিবৃত্তীয়
বালিয়াড়ি (Parabolic Dune):
☻সংজ্ঞাঃ মরুভূমি অঞ্চলে বায়ুর অপসারণ প্রক্রিয়ার ফলে
সৃষ্ট গর্তগুলির প্রতিবাত ঢাল থেকে বালি অপসারিত হয়ে অনুবাত ঢালে সঞ্চিত হয়ে
অধিবৃত্তের ন্যায় যে বালিয়াড়ি সৃষ্ট হয়, তাকে অধিবৃত্তীয় বালিয়াড়ি (Parabolic
Dune) বলে
।
বৈশিষ্ট্যঃ অধিবৃত্তীয় বালিয়াড়ি – র বৈশিষ্ট্যগুলি হল নিম্নরূপ –
ক) এইপ্রকার ভূমিরূপ বেলচা
বা চামচের গর্তের মত আকৃতিবিশিষ্ট হয় ।
খ) এর প্রতিবাত ঢাল অনুবাত ঢালের থেকে কম হয়
।
দ্রাস
বালিয়াড়ি (Drush Dune):
বৈশিষ্ট্যঃ দ্রাস বালিয়াড়ি – র বৈশিষ্ট্যগুলি হল নিম্নরূপ –
ক) এগুলি
বায়ুর গতিপথের সাথে সমান্তরালে অবস্থান করে ।
খ) এরা দৈর্ঘ্যে প্রায় ১৫০ কিমি, প্রস্থে
১-৩ কিমি ও উচ্চতায় প্রায় ৪০০ মিটার পর্যন্ত হয় ।
উল্টানো
বালিয়াড়ি (Reverse Dune):
☻সংজ্ঞাঃ প্রাথমিক ঢালের ঠিক বিপরীত দিকে আরো একটি
অপ্রধান ঢালযুক্ত শৈলশিরার ন্যায় আকৃতিবিশিষ্ট বালিয়াড়িকে উল্টানো বালিয়াড়ি (Reverse
Dune) বলে
।
বৈশিষ্ট্যঃ উল্টানো বালিয়াড়ি – র বৈশিষ্ট্যগুলি হল নিম্নরূপ –
ক) এইপ্রকার বালিয়াড়ি বায়ুর প্রবাহপথে
আড়াআড়িভাবে অবস্থান করে ।
খ) তীর্যক বালিয়াড়ি ও বার্খান বালিয়াড়ির
মধ্যে এদের অবস্থান দেখা যায় ।
গ) দুটি সমশক্তিসম্পন্ন বিপরীতমুখী বায়ুপ্রবাহের স্থায়িত্বকাল সমান হলে এরূপ
বালিয়াড়ি গড়ে ওঠে ।
চুলের
কাঁটার ন্যায় বালিয়াড়ি (Hairpin Dune):
☻সংজ্ঞাঃ অধিবৃত্তীয় বালিয়াড়ি প্রসারিত হতে হতে
দীর্ঘ, সংকীর্ণ ও সমান্তরাল ঢালযুক্ত বালিয়াড়ি
সৃষ্টি হলে, তাকে চুলের কাঁটার ন্যায় বালিয়াড়ি (Hairpin
Dune) বলে
।
বৈশিষ্ট্যঃ চুলের কাঁটার ন্যায় বালিয়াড়ি –
র
বৈশিষ্ট্যগুলি হল নিম্নরূপ –
ক) অধিবৃত্তীয় বালিয়াড়ি থেকে এইপ্রকার
বালিয়াড়ি সৃষ্টি হয় ।
খ) কখনও কখনও এগুলির উপর উদ্ভিদ জন্মালে এরা
স্থির বালিয়াড়িতে পরিনত হয় ।
মস্তক
বালিয়াড়ি (Head Dune),পুচ্ছ বালিয়াড়ি (Tail
Dune) ও পার্শ্ব বালিয়াড়ি (Lateral Dune):
☻মস্তক বালিয়াড়ি (Head Dune): বায়ুপ্রবাহ তার গতিপথে কোন বাঁধার
সম্মুখীন হলে সেই বাঁধার প্রতিবাত অংশে যে বালিয়াড়ি গড়ে ওঠে, তাকে মস্তক বালিয়াড়ি (Head Dune) বলে ।
বৈশিষ্ট্যঃ মস্তক বালিয়াড়ি – র বৈশিষ্ট্যগুলি হল নিম্নরূপ –
ক) এরা আকৃতিতে অপেক্ষাকৃত ছোট হয় ।
খ) এদের আকৃতি অনেকটা পাখির ঠোঁটের মত হয় ।
☻পুচ্ছ বালিয়াড়ি (Tail Dune): বায়ুপ্রবাহ তার গতিপথে কোন বাঁধার
সম্মুখীন হলে সেই বাঁধার পিছনদিকেও অল্প পরিমানে বালি পরিবাহিত হয়
এবং তা ঐ স্থানে থিঁতিয়ে পড়ে বালিয়াড়ি সৃষ্টি হলে, তাকে পুচ্ছ বালিয়াড়ি (Tail Dune) বলে ।
বৈশিষ্ট্যঃ পুচ্ছ বালিয়াড়ি – র বৈশিষ্ট্যগুলি হল নিম্নরূপ –
ক) এরা আকৃতিতে অপেক্ষাকৃত ছোট হয় ।
খ) এরা দেখতে স্তূপাকৃতি হয় ।
☻পার্শ্ব বালিয়াড়ি (Lateral Dune): বায়ু তার প্রবাহপথে বাঁধার সম্মুখীন হলে
বাঁধার দু পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয় । এর ফলে বাঁধার দুই পাশে বালি থিঁতিয়ে পড়ে যে বালিয়াড়ির
সৃষ্টি হয়,তাকে পার্শ্ব বালিয়াড়ি (Lateral Dune) বলে ।
বৈশিষ্ট্যঃ পার্শ্ব বালিয়াড়ি – র বৈশিষ্ট্যগুলি হল নিম্নরূপ –
ক) এরা আকৃতিতে অপেক্ষাকৃত ছোট হয় ।
খ) এরা দেখতে দণ্ডাকৃতি হয় ।
অগ্রবর্তী
বালিয়াড়ি (Advanced Dune) ও পরবর্তী বালিয়াড়ি (Wake Dune):
☻ অগ্রবর্তী বালিয়াড়ি (Advanced Dune): অনেক সময় ঘূর্ণি বায়ুপ্রবাহের প্রভাবে মস্তক বালিয়াড়িরকিছুটা আগে অপর একপ্রকার বালিয়াড়ির সৃষ্টি হয় ।
একে অগ্রবর্তী বালিয়াড়ি (Advanced Dune) বলে ।
বৈশিষ্ট্যঃ অগ্রবর্তী বালিয়াড়ি – এর বৈশিষ্ট্যগুলি হল নিম্নরূপ –
ক) এইপ্রকার
বালিয়াড়ি আকৃতিতে অপেক্ষাকৃত ছোট হয় ।
খ) এরা দেখতে স্তূপাকৃতি হয় ।
☻ পরবর্তী বালিয়াড়ি (Wake Dune): পুচ্ছ বালিয়াড়ির পরবর্তী পর্যায়ে যে
বালিয়াড়ির সৃষ্টি হয়, তাকে পরবর্তী বালিয়াড়ি (Wake Dune) বলে ।
বৈশিষ্ট্যঃ পরবর্তী বালিয়াড়ি – এর বৈশিষ্ট্যগুলি হল নিম্নরূপ –
ক) এইপ্রকার বালিয়াড়ি আকৃতিতে
অপেক্ষাকৃত ছোট হয় ।
খ) এরা দেখতে ক্ষুদ্র স্তূপাকৃতি হয় ।