Tuesday, August 31, 2021

ন্যায় বিচারের উপর একটি টীকা লেখো।

 18. 

রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে, ন‍্যায়বিচারের মাধ্যমে কোনো সমাজের ভাল বা মন্দ বোঝা যায়। ন্যায় বিচারের অস্তিত্বের উপর সামাজিক উৎকর্ষ নির্ভরশীল। ন্যায় বিচারের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা ভিন্নমত পোষণ করেছেন। যেসব দৃষ্টিকোণ থেকে ন্যায় বিচারের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করা হয়ে থাকে সেগুলি হল-

1) সাবেকি উদার নৈতিক দৃষ্টিকোণ:

!) বৃহত্তর সামাজিক স্বার্থ ও কর্তব্যপালন:-প্রাচীন গ্রিক রাষ্ট্রচিন্তায় ন্যায়বিচারের প্রকৃতি সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে প্লেটো তাঁর ''দ্য রিপাবলিক" গ্রন্থে কয়েকটি আদর্শ মতামতকে তুলে ধরেন। তার মতে, ব্যক্তিস্বার্থের দ্বারা নয়, বৃহত্তর সামাজিক স্বার্থ ও কর্তব্যপালনের মধ‍্য দিয়ে ন‍্যয়বিচারের সন্ধান করা যেতে পারে। প্লেটো মনে করতেন, সমাজের বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে সমন্বয় সাধন করা হলে ন‍্যায়বিচারের প্রতিষ্ঠা সম্ভব। তাঁর অভিমত ছিল, অন‍্যের কাজে হস্তক্ষেপ না করে প্রত‍্যেকে নিজের যোগ‍্যতা অনুসারে কর্তব্য পালন করলে এই সমন্বয় বজায় রাখা যায়।

!!) সামাজিক বাস্তবতা:- ব্রিটিশ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আর্নেস্ট বার্কার উদারনীতিবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে ন্যায়বিচারের প্রকৃতির বিশদ ব্যাখ্যা দিয়েছেন। বার্কারের মতে, ন্যায়বিচারের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করার আগে উৎস সম্পর্কে সঠিক ধারণা থাকা প্রয়োজন। ন্যায় বিচারের চারটি প্রধান উৎস রয়েছে সেগুলি হল-

১। ধর্ম,

২।প্রকৃতি,

৩। অর্থনীতি এবং

৪। নীতিশাস্ত্র। এক্ষেত্রে উৎস হিসেবে নীতিশাস্ত্র কে বার্কার সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য বলে মনে করেছেন। তিনি মনে করেন, ন‍্যায়বিচার যদিও নৈতিকতা নয়, তবুও তা নৈতিকতার উপর প্রতিষ্ঠিত। ন্যায় বিচার সম্পর্কিত নিয়মাবলী চূড়ান্তভাবে নীতিশাস্ত্র থেকে উদ্ভূত। বর্কারের মতে, ন্যায়বিচার কোন তত্ত্বগত বিমুর্ত ধারণা নয়। ন্যায়বিচার হল একটি সামাজিক বাস্তবতা। তাঁর মতে ন্যায়বিচারের ধারণা প্রত্যেকের মধ্যে বিরাজ করছে। বার্কারের মতে, রাষ্ট্রের সাহায্যে মানব-সম্পর্ককে সুবিন্যাস্ত করার নীতি হলো ন‍্যায়বিচার। এই কারণেন‍্যায়ের শাসন অক্ষুন্ন রাখা রাষ্ট্রের প্রধান উদ্দেশ্য। ন‍্যায়ভিত্তিক সমাজের স্বার্থে রাষ্ট্রীয় আইনকে মূল্যবোধের সঙ্গে সম্পর্কিত করা দরকার বলে তিনি মনে করতেন। তাঁর মতে, রাষ্ট্রীয় জীবনের প্রতিটি স্তরে ন্যায়ের শাসন বজায় থাকলে ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের মহোত্তম বিকাশসাধন সম্ভব।

!!!)সর্বাধিক সংখ্যক মানুষের সর্বাধিক কল্যাণ:-দার্শনিক বেন্থাম ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট্রকে সর্বাধিক সংখ্যক মানুষের সর্বাধিক কল্যাণের নীতি গ্রহণের পরামর্শ দেন।

2)নয়া উদারনৈতিক দৃষ্টিকোণ:-সমান স্বাধীনতা, সমান সুযোগ-সুবিধা, বিশেষ অধিকার, নয়া উদারনীতিবাদের অন্যতম প্রধান প্রবক্তা জন রলস 1971 সালে প্রকাশিত তাঁর "এ থিউরি অফ জাস্টিস" গ্রন্থে ন্যায় বিচারের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে নতুন ধারণার অবতারণা করেন। তিনি ন্যায়বিচারকে ক্ষমতা, সুযোগ-সুবিধা, অধিকার, স্বাধীনতা, আত্মমর্যাদা, আয় ও সম্পদের মতো প্রাথমিক সামগ্রীর ন্যায্য বন্টন হিসাব অভিহিত করেন। তাঁর মতে, সমবণ্টন হল ন্যায়বিচারের প্রধান উৎস। এজন্য তিনটি মূলনীতির কথা রলস উল্লেখ করেন। সেগুলি হল-

১। প্রতিটি ব্যক্তির সমান স্বাধীনতা লাভের অধিকার,

২। চাকরি ও মর্যাদালাভের ক্ষেত্রে সকলের সমান সুযোগ সুবিধা,

৩। ন্যায়বিচারের স্বার্থে সামাজিকভাবে দূর্বলতর ব্যক্তি বা শ্রেণীর জন্য বিশেষ অধিকার বা বিশেষ ব্যবস্থা সংস্থান। 

এই শোষোক্ত নীতিটি গ্রহণের ফলে সামাজিকভাবে অনগ্রসর ও দুর্বলতর জনগোষ্ঠীর লোকেরা অন্যদের সঙ্গে একই সারিতে উন্নীত হতে পারবে। রলসের বক্তব্য হল, সংখ্যাগরিষ্ঠৈর কল্যাণ নয়, সমস্ত মানুষের কল‍্যাণই ন‍্যায়বিচারের উদ্দেশ্য। এই কারণে দুর্বলতর শ্রেণীর জন্য বিশেষ সুযোগ-সুবিধা ব্যবস্থাকে তিনি ন্যায়বিচারের অঙ্গ বলেছিল। নয়া উদারনীতিবাদী তাত্ত্বিক রবার্ট নোজিক ন্যায়বিচার সম্পর্কিত রলসের এই তত্বের সমালোচনা করেন। নোজিকের মতে, সৎ উপায়ে অর্জিত বা উত্তরাধিকারসূত্রে বা হস্তান্তরের মাধ্যমে প্রাপ্ত সম্পত্তির উপর ব্যক্তির ন্যায় সঙ্গত অধিকার রয়েছে। এক্ষেত্রে রাষ্ট্র কর্তৃক কোনো বঞ্চনা ন্যায় প্রতিষ্ঠার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে বলে তিনি মনে করেন।

3)মার্কসীয় ন্যায়বিচার:-মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে, অর্থনৈতিক শোষণ ও বৈষম্যযুক্ত সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনা। মার্কসবাদীরা ন্যায়বিচার বলতে অর্থনৈতিক ন্যায়বিচারকে বোঝান। একমাত্র সমাজতান্ত্রিক সমাজে ন‍্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা সম্ভব বলে তাঁরা মনে করেন।

উপসংহার:- ন্যায়বিচারের প্রকৃতি মানবসভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে পরিবর্তিত হয়েছে তাই একথা বলা যায় যে, ন্যায় বিচারের প্রকৃতি পরিবর্তনশীল।

No comments: