Tuesday, August 31, 2021

আইনের অর্থ ও প্রকৃতি বিশ্লেষণ করো। অথবা আইনের সংজ্ঞা দাও ও আইনের প্রকৃতি ব্যাখ্যা করো। অথবা আইনের সংজ্ঞা দাও আইনের বৈশিষ্ট্য গুলি কি কি?

 1.

আইনের অর্থ 

আইন কথাটি দুটি অর্থে ব্যবহৃত হয় 1)সংকীর্ণ ও 2)ব্যাপক।

তবে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে আইন শুধুমাত্র সংকীর্ণ অর্থে ব্যবহৃত হয়। এখানে রাষ্ট্রপতি সৃষ্ট বা স্বীকৃত আইন একমাত্র আলোচ্য বিষয়।

1) অধঃস্তনের প্রতি ঊর্ধ্বতনের আদেশ:- রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে আইনের সংজ্ঞা দিয়েছেন। জন অস্টিন এর মতে, আইন হল অধস্তনের প্রতি ঊর্ধ্বতনের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব আদেশমাত্র। বিশ্লেষণ পন্থী লেখক হল্যান্ডের মতে, সার্বভৌম রাষ্ট্রনৈতিক কর্তৃত্ব দ্বারা প্রযুক্ত মানুষের বাহ্যিক আচরণ নিয়ন্ত্রণকারী সাধারন নিয়মই হল আইন।

2) সব আইন সার্বভৌম শক্তির দেশ নয়:-  স‍্যাভিনি, হেনরি মেইন, মেইটল্যান্ড ক্লার্ক প্রমুখ ঐতিহাসিক মতবাদে বিশ্বাসী বিজ্ঞানীদের মতে সমাজে প্রচলিত রীতি-নীতি, প্রথা ইত্যাদি সাধারণভাবে আইনের মর্যাদা লাভ করে। তাই সব আইনকে সার্বভৌম শক্তির আদেশ বলে অভিহিত করা যুক্তিযুক্ত নয়। দ‍্যুগুই, ক্র‍্যবে প্রমুখ সমাজ বিজ্ঞানীর মতে, নানান সামাজিক কারণ ও প্রভাবের ফলে আইনে সৃষ্টি হয় এবং আইন সমাজের কল্যাণ সাধন করে বলেই মানুষ তা মেনে চলে।

3) রাষ্ট্র দ্বারা গৃহীত মানুষের আচার-ব্যবহার ও চিন্তার অংশ:- উইলসনের মতে, আইন হলো মানুষের স্থায়ী আচার, ব্যবহার ও চিন্তার সেই অংশ যা রাষ্ট্র কতৃক গৃহীত বিধিতে পরিণত হয়েছে এবং যার পিছনে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের সুস্পষ্ট সমর্থন আছে।

 4)বৈধ এবং নৈতিক মূল্যবিশিষ্ট:- বার্কলের অভিমত হলো, আইন শুধুমাত্র রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত, ঘোষিত এবং প্রযুক্ত হয়েই চলবে না, তাকে নেয সম্মত ও যুক্তিসঙ্গত হতে হবে। তার মতে, আইনের দুটি উপাদান-1) বৈধতা এবং 2)নৈতিক মূল্য। 

বৈধতা বলতে বোঝায় আইনটি রাষ্ট্রকর্তৃক অনুমোদিত, ঘোষিত এবং প্রযুক্ত; অন্যদিকে নৈতিক মূল্যের অর্থ হলো আইনটি ন‍্যয়বোধের উপর প্রতিষ্ঠিত।

 5)শাসক শ্রেণীর ইচ্ছা:- মার্কসীয় মতবাদ অনুযায়ী, আইন রাষ্ট্র প্রকৃতির সঙ্গে অভিন্ন ভাবে জড়িত। সমাজের প্রচলিত উৎপাদন সম্পর্কে বজায় রাখার জন্য রাষ্ট্র আইন তৈরি করে। আইন শাসকশ্রেণীর ইচ্ছাকে প্রতিফলিত করে।

 আইনের প্রকৃতি

আইনের প্রকৃতি সম্পর্কিত মতবাদ গুলি হল নিম্নলিখিত-

 1)দার্শনিক মতবাদ:-আইনকে বাস্তব দৃষ্টিতে বিচারবিশ্লেষণ করার বদলে আদর্শের প্রকাশ হিসেবে বর্ণনার মাধ্যমে দার্শনিক মতবাদের সূচনা হয়। দার্শনিক মতবাদ আইনব্যবস্থাকে নৈতিক মানদণ্ডে বিচার করতে চায়। অ্যারিস্টোটল আইনকে যুক্তিনির্ভর বুদ্ধির প্রকাশ বা Expression of Reasons বলে বর্ণনা করেছিলেন। স্টোয়িক দার্শনিকরা প্রাকৃতিক আইন বা natural law কে আইনের স্বীকৃতি দিয়েছেন। রুশোর মতে, আইন হলো সাধারণ ইচ্ছার প্রকাশ।

 2)বিশ্লেষণমূলক মতবাদ:-এই মতবাদ অনুসারে আইনের প্রতি স্বাভাবিক আনুগত্য দেখানো জনগণের কর্তব্য। ব্রিটিশ দার্শনিক হব্স সার্বভৌম শক্তির অধিকারী রাজা আজকে আইন বলে বর্ণনা করেছেন। অস্টিনের মতে, আইন হলো সার্বভৌমের আদেশ। এই আইনের সঙ্গে নৈতিক অথবা প্রথার কোনো সম্পর্ক নেই।

3)ঐতিহাসিক মতবাদ:-সমাজ প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে। এই পরিবর্তনের নেপথ্যে যেসব প্রথা, রীতিনীতি, লোকাচার প্রভৃতি কাজ করে, কালক্রমে সেগুলো আইনের মর্যাদা পায়। কাজেই আইনকে শুধুমাত্র সার্বভৌম শক্তির আদেশ হিসাবে মেনে নেয়া যায় না। স‍্যাভিনির মতে, আইন সৃষ্টি করা রাষ্ট্রের কাজ নয়। আইনের প্রয়োগ করা হল রাষ্ট্রের প্রকৃত কাজ।

4)তুলনামূলক মতবাদ:-তুলনামূলক মতবাদের প্রবক্তা হলেন ইংল্যান্ডের এক বিখ্যাত আইনবিদ স‍্যার ভিনগ্রাডফ। এই মতবাদ  আইনব্যবস্থার প্রকৃতি উদঘাটনের জন্য তুলনামূলক আলোচনায় বিশ্বাসী। এজন্য বিভিন্ন দেশের আইন ব্যবস্থার মধ্যে তুলনামূলক আলোচনা করা হয়। এই আলোচনার মধ্যে দিয়ে আইনব্যবস্থার বিকাশের একটা ধারণা পাওয়া যায়। যেমন কোন রাষ্ট্রে দমনমূলক আইন প্রয়োগ যথেচ্ছভাবে ঘটলে সেখানে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। তুলনামূলক মতবাদ অনুযায়ী অতীতের আইনব‍্যবস্হার সঙ্গে বর্তমানের আইন ব্যবস্থার মধ্যে তুলনামূলক আলোচনার মাধ্যমে আইনের প্রকৃতি সম্পর্কে একটি সাধারণ সিদ্ধান্ত পৌঁছানো যায়।

5)সমাজবিজ্ঞান মুলক মতবাদ:-এটি আইনের প্রকৃতি বিশ্লেষণ অন্যতম আধুনিক মতবাদ। এই মতবাদের প্রবক্তা দের মতে, সামাজিক কল্যাণসাধনের উদ্দেশ্যেই আইনের সৃষ্টি হয়েছে। আইন সমাজের কল্যাণ সাধন করে বলে লোক আইন মেনে চলে। কারণ রাষ্ট্র সৃষ্টির আগেই এর উৎপত্তি হয়েছিল।আইন হল সমাজের আচার-আচরণ নিয়ন্ত্রণকারী কয়েকটি নিয়ম কানুন মাত্র। ব্যাক্তি সামাজিক ঐক্যের দিকে প্রয়োজনের সচেতনভাবে আইন মেনে চলে। 

6)মার্কসীয় মতবাদ:- এই মতবাদ অনুসারে, আইন রাষ্ট্র প্রকৃতির সঙ্গে অভিন্ন ভাবে জড়িত। সামাজের প্রচলিত উৎপাদন সম্পর্ককে বজায় রাখার জন্য রাষ্ট্র আইন তৈরি করে। মার্কস ও অ্যাঞ্জেলেসর মতে, শাসকশ্রেণীর ইচ্ছা ছাড়া আইন আর কিছু নয়। সমাজবিকাশের বিভিন্ন স্তরে প্রতিপত্তিশালী শ্রেণি নিজেদের স্বার্থে আইনকে কাজে লাগিয়ে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে।

উপসংহার:- আইনের অর্থ প্রকৃতি সতত পরিবর্তনশীল। সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আইন এর অর্থ ও প্রকৃতি বদল ঘটছে। 

No comments: