6.
জাতীয়তাবাদ ও আন্তর্জাতিকতাবাদের মধ্যে সম্পর্ক
জিমার্ন, ম্যাৎসিনি, রাসেল প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মনে করেন জাতীয়তাবাদ ও আন্তর্জাতিকতাবাদ একে অপরের পরিপূরক। আবার ল্যাস্কি, গার্নার, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখ জাতীয়তাবাদকে আন্তর্জাতিকতার পরিপন্থী বলে মনে করেন। জাতীয়তাবাদ হল একটি জনসমাজের গভীর স্বাতন্ত্র্যবােধের প্রকাশ। জাতীয়তাবাদ এমন এক মানসিকতা যা প্রত্যেক জাতীয় জনসমাজকে তাদের নিজস্ব সত্তা সম্পর্কে সজাগ হতে সাহায্য করে। অন্যদিকে, আন্তর্জাতিকতা এক মহান আদর্শে অনুপ্রাণিত মানসিক অনুভূতি। বিভিন্ন জাতির স্বাতবােধ বিসর্জন না দিয়ে এক বিশ্বসমাজ গড়ে তােলাই এর মুখ্য উদ্দেশ্য।
জাতীয়তাবাদ ও আন্তর্জাতিকতাবাদের মূল বিষয়:-
1)জাতীয়তাবাদ আন্তর্জাতিকতাবাদ বিরোধ:-বিংশ শতাব্দীর তিনের দশকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ পরিণামের পর আন্তর্জাতিকতার ধারণাটি উত্থাপিত হয়। বিভিন্ন দেশের মনীষীরা সেসময় জাতীয়তাবাদ ও জাতীয় রাষ্ট্রের ধ্যান-ধারণার বিরুদ্ধে সরব হন। জাতীয়তাবাদকে চিহ্নিত করা হয় আন্তর্জাতিকতার বিরোধী হিসাবে। তাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেন- জাতীয়তাবাদ মানব সভ্যতার শত্রু।
2)উগ্র বা বিকৃত জাতীয়তাবাদ ও আন্তর্জাতিকতা:-উগ্র বা বিকৃত জাতীয়তাবাদ মানবতা ও আন্তর্জাতিকতার বিরোধী। সংকীর্ণ আত্মকেন্দ্রিক ও আগ্রাসী জাতীয়তাবাদ মানবসভ্যতাকে ধ্বংসের দিকে এগিয়ে দিয়েছে। নিজের জাতির শ্রেষ্ঠ এমন ধারণা এবং অন্য জাতি, কৃষ্টি ও সভ্যতার প্রতি ঘৃণার মনোভাব বিকৃত জাতীয়তাবাদে দেখা যায়। উগ্র জাতীয়তাবাদের মাধ্যমে অন্ধ স্বদেশপ্রীতি জনসাধারণকে আসক্ত করায় যুদ্ধ সংঘটিত হয়। বিকৃত জাতীয়তাবাদের সাহায্যে জাতির মধ্যে সাম্রাজ্য বিস্তারের আকাঙ্ক্ষা দেখা দেয়। অন্য জাতিকে পদানত করে স্বজাতির মহিমা প্রতিষ্ঠার এই চেষ্টা যুদ্ধে রূপ নেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি, ইতালি ও জাপানের বিধ্বংসী ভূমিকা উগ্র জাতীয়তাবাদের এক জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। এইভাবে উগ্র এবং বিকৃত জাতীয়তাবাদের মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদ, ঔপনিবেশিকতা, নয়া উপনিবেশিকতার উদ্ভব হয়।
3)আদর্শ জাতীয়তাবাদ ও আন্তর্জাতিকতা:-আদর্শ জাতীয়তাবাদের সঙ্গে আন্তর্জাতিকতার একটি সুসম্পর্ক রয়েছে। আদর্শ জাতীয়তাবাদ মানুষের মনে যে স্বদেশপ্রীতির সৃষ্টি করে তা ক্রমেই বিশ্বপ্রীতিতে রূপান্তরিত হয়। আদর্শ জাতীয়তাবাদ নিজের জাতিকে ভালবাসতে শেখায়, সঙ্গে সঙ্গে অপর জাতিকে ভালোবাসার জন্য প্রেরণা দেয়। আদর্শ জাতীয়তাবাদ প্রগতিশীল। এর ফলে আন্তর্জাতিকতার পথ উন্মুক্ত হয়। প্রকৃত জাতীয়তাবাদী চিন্তাধারা কখনো সংকীর্ণ স্বার্থও চেতনার মধ্যে আবদ্ধ থাকে না। পৃথিবীর সব দেশ ও মানুষের কল্যাণ কামনায় তা নিয়োজিত হয়। আদর্শ জাতীয়তাবাদ নিজে বাঁচো এবং অপরকে বাঁচতে দাও এই বক্তব্য প্রচার করে বিশ্বসভ্যতার প্রগতিকে উন্মুক্ত করেছে। তাই জাতীয়তাবাদ হল আন্তর্জাতিকতাবাদের উত্তরণের অন্যতম সোপান।
4)জাতীয়তাবাদী মুক্তি আন্দোলন ও আন্তর্জাতিকতা:- প্রকৃত জাতীয়তাবাদ আন্তর্জাতিকতাকে শক্তিশালী করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এশিয়া, আফ্রিকা এবং লাতিন আমেরিকায় সাম্রাজ্যবাদবিরোধী জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের মাধ্যমে বহু দেশ স্বাধীনতার স্বাদ পেয়েছে। এই তিন মহাদেশের সাম্রাজ্যবাদবিরোধী জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম আন্তর্জাতিকতার আদর্শকে শক্তিশালী করেছে। নির্যাতিত জাতির মুক্তি আন্দোলনে বিশ্ববাসীর সমর্থন আন্তর্জাতিকতার পথ প্রশস্ত করে।
উপসংহার:- জাতীয়তাবাদ ও আন্তর্জাতিকতাবাদ সমন্বয় সাধন খুবই জটিল। বিভিন্ন আন্তরাষ্ট্রীয় সম্পর্ক মূলত জাতীয় স্বার্থের দ্বারাই পরিচালিত। বস্তুতপক্ষে মানব সভ্যতার যথার্থ বিকাশের জন্য জাতীয়তাবাদ ও আন্তর্জাতিকতাবাদ এর সুষ্ঠু সমন্বয় সাধন অত্যন্ত জরুরী। এই সর্বনাশা ধোনের উপর মানব সভ্যতার ভবিষ্যৎ নির্ভরশীল বলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা মনে করেন।
বস্তুতপক্ষে,
মানবসভ্যতার যথার্থ বিকাশের জন্য জাতীয়তাবাদ ও আন্তর্জাতিকতাবাদের সুষ্ঠু সমন্বয়সাধন অত্যন্ত জরুরি।
No comments:
Post a Comment