Tuesday, August 31, 2021

জাতীয়তাবাদের অর্থ ও বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করো।

 3. 

জাতীয়তাবাদের অর্থ



জাতীয়তাবাদ হল এমন এক মতাদর্শ যা জাতির আত্মপ্রতিষ্ঠার দাবিকে বাস্তবায়িত করতে সাহায্য করে। কোনাে জনসমাজের মধ্যে বংশ, ধর্ম, ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি প্রভৃতি নানা কারণে যখন গভীর একাত্মবােধের সৃষ্টি হয় এবং এই একাত্মবােধের জন্য জনসমাজের প্রত্যেকে যখন নিজেকে সুখ-দুঃখ, ন্যায়-অন্যায়, মান-অপমানের সমান অংশীদার বলে মনে করে তখন জাতীয়তাবোধের জন্ম হয়। দেশপ্রেম এই জাতীয়তাবােধের সঙ্গে মিলিত হয়ে জাতীয়তাবাদের সৃষ্টি করে। 



[1] বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর অভিমত: বার্ট্রান্ড রাসেলের মতে, জাতীয়তাবাদ হল এমন এক সাদৃশ্য ঐক্যের অনুভূতি যা পরস্পরকে ভালােবাসতে শেখায় ("Nationalism is a sentiment of similarity and solidarity") রাষ্ট্রবিজ্ঞানী লয়েড জাতীয়তাবাদকে আধুনিক বিশ্বের ধর্ম বলে বর্ণনা করেছেন। লেনিন নিপীড়নকারী শাসকশ্রেণির বিরুদ্ধে শােষিত নির্যাতিত জাতির গণতান্ত্রিক আন্দোলন হিসেবে জাতীয়তাবাদকে দেখেছেন



[2] বিকাশ: জাতীয়তাবাদের ধারণা ১৭৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লবের সময় পূর্ণতা লাভ করে। ১৭৮৯ সালের অক্টোবর ফরাসি সরকারের মৌলিক আদর্শ ঘােষণা করে বলা হয়, "জাতি হল সমস্ত ক্ষমতার উৎস। জাতীয়তাবাদের প্রভাবে জার্মানি, ইতালি, স্পেন রাশিয়ায় প্রতিরােধ সংগ্রাম গড়ে ওঠে। ১৮০৭ সালে দার্শনিক ফিকটে জাতির উদ্দেশ্যে এক ঘােষণায় মানুষকে দেশপ্রেমের অগ্নিশিখায় উদ্দীপ্ত করে হাসিমুখে জাতির জন্য আত্মবলিদানের আহ্বান জানান



[3] জাতীয়তাবাদের বৈশিষ্ট্য: জাতীয়তাবাদের উল্লেখযােগ্য বৈশিষ্ট্যগুলি হল

(i) ঐতিহাসিক পরিবর্তনশীল প্রকৃতি:-জাতীয়তাবাদের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এর ঐতিহাসিক ও পরিবর্তনশীল প্রকৃতি। জোসেফ ফ্র্যাঙ্কেলের  মতে, পশ্চিম ইউরোপের ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, স্পেনে যে জাতীয়তাবাদের উৎপত্তি ঘটে, পরে তা ক্রমশ ইউরোপের বিভিন্ন অংশে এবং অন্যান্য মহাদেশের ছড়িয়ে পড়ে। জাতীয়তাবাদ বস্তুতপক্ষে বিগত পাঁচশো বছরের ইতিহাসে ফসল। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের অভিমত অনুসারে, বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের পতন (1453) থেকে শুরু করে ওয়েস্টফেলিয়া শান্তি চুক্তি (1648), আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ (1776), ফরাসি বিপ্লব (1789), প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, তৃতীয় বিশ্বের মুক্তিসংগ্রাম সবকিছুর মধ্যে জাতীয়তাবাদের ঐতিহাসিক বিকাশের সন্ধান পাওয়া যায়।

 (ii) বিবিধ রূপে প্রকাশিত:- জাতীয়তাবাদের নানা রূপ রয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিখ্যাত লেখক  কুইন্সি রাইট জাতীয়তাবাদী কয়েকটি রূপের কথা তুলে ধরেছেন। সেগুলি হল- রাজতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদ, বিপ্লবী জাতীয়তাবাদ, উদারনৈতিক জাতীয়তাবাদ, জঙ্গী ও স্বৈরতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদ।

 (iii) ভাবগত ঐক্যের সহায়ক:- জাতীয়তাবাদের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা একই একটি ভাবগত বা মানসিক ঐক্যের ধারণা বলে বর্ণনা করেছেন

 (iv) রাষ্ট্রের মুখ্য উপাদান:- জাতীয়তাবাদ নতুন রাষ্ট্র কাঠামো গঠনে উৎসাহ দেয়। জাতীয়তাবাদ ও জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার একে অপরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত। এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার উপনিবেশগুলোতে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী জাতীয় মুক্তি আন্দোলনে এক অদম্য প্রেরণা যুগিয়েছে জাতীয়তাবাদ।

(v) গণসার্বভৌমিকতার আদর্শ স্বীকৃত:- জাতীয়তাবাদ মতাদর্শে গণ সার্বভৌমিকতার তত্ত্বের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। 1779 খ্রিস্টাব্দে ফরাসি বিপ্লবের পটভূমিকায় রচিত মানবাধিকার সনদে জাতিকে সার্বভৌম ক্ষমতার উৎস হিসাবে বর্ণনা করা হয়। এভাবে জাতীয়তাবাদের জাতি তথা জনগণের সার্বভৌমত্ব শিক্ষিত আদর্শরূপে প্রতিষ্ঠা লাভ করে।

(vi) নেতিবাচক ইতিবাচক দিকের অস্তিত্ব:- জাতীয়তাবাদের নীতি বাচক দিককে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা উগ্র বা বিকৃত জাতীয়তাবাদ বলেছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলারের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা জার্মানির নাৎসি জাতীয়তাবাদ একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। অন্যদিকে, সাম্রাজ্যবাদী ঔপনিবেশিক শক্তির অধীনে থাকা ভারতসহ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির জাতীয়তাবাদী মুক্তি সংগ্রাম হল জাতীয়তাবাদের ইতিবাচক দিক।

(vii) মুক্তির দিশারি:- পরাধীন দেশগুলির কাছে জাতীয়তাবাদ মুক্তির দিশারী রূপে কাজ করে। ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে উৎখাত করার জন্য ভারতবাসী জাতীয়তাবাদী আদর্শে দীক্ষিত হয়ে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আমরণ সংগ্রামে উদবুদ্ধ হয়েছিল। এভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকার প্রায় 100 টিরও বেশি দেশ পরাধীনতার শৃংখল মোচন করে মুক্তি লাভ করে।

(vii) ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতীক:- জাতীয় রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্যের কথা প্রচার করে জাতীয়তাবাদ এক প্রগতিশীল ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করে। এভাবে রাজনীতি থেকে ধর্মকে বিচ্ছিন্ন করে ইউরোপে জাতীয়তাবাদের প্রবক্তারা জাতীয় রাষ্ট্রের ধারণা প্রচার করে। যে জন্য জাতীয়তাবাদকে ধর্মনিরপেক্ষতার রূপ বলা হয়।

(ix) জাত্যাভিমানের প্রতীক:- অনেক সময় জাতীয়তাবাদ জাতির মধ্যে জাত্যভিমান এরও জন্ম দিয়ে থাকে। এর ফলে জাতিবিদ্বেষের সৃষ্টি হয়। শুধুমাত্র নিজের জাতিকে শ্রেষ্ঠ বলে মনে করার ফলে নিজেদের সংস্কৃতি ও সভ্যতা অন্য জাতির উপর চাপিয়ে দেয়ার প্রবণতা জন্মায়। জার্মানি ও ইতালিতে হিটলার ও মুসোলিনির এভাবে জাতীয়তাবাদের মাধ্যমে জাত্যভিমানী প্রসার ঘটিয়েছিল।

 (x) আন্তর্জাতিক সম্প্রীতির সহায়ক:-জাতীয়তাবাদ যখন আদর্শ জাতীয়তাবাদ হয়ে ওঠে তখন তা সহযোগিতা, সম্প্রীতি ও আন্তর্জাতিকতার সহায়ক হয়। জাতীয়তাবাদের মূলমন্ত্র হলো "নিজে বাঁচো ও অপরকে বাঁচতে দাও"। আদর্শ জাতীয়তাবাদ পৃথিবীর বিভিন্ন জাতির মধ্যে সহযোগিতা ও সৌভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে জাতিগুলির মধ্যে পারস্পরিক বৈরীভাব দূর করে। তাই আদর্শ জাতীয়তাবাদকে আন্তর্জাতিকতার পরিপূরক বলে মনে করা হয়।

উপসংহার:- উপরিউক্ত আলোচনায় এটা স্পষ্ট যে জাতীয়তাবাদ একটি মুক্তিকামী আদর্শ যেখানে জনগণকে পরাধীন হওয়ার সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করে।

No comments: