Tuesday, August 31, 2021

আন্তর্জাতিকতার গুরুত্ব বিশ্লেষণ করো। জাতীয়তাবাদ ও আন্তর্জাতিকতাবাদ কি পরস্পর বিরোধী?

 

14. 

আন্তর্জাতিকতার গুরুত্ব

আন্তর্জাতিকতা হলো এক মহান আদর্শ--বিশ্ব ভ্রাতৃত্ব ও বিশ্ব শান্তির আদর্শের ধারক ও বাহক।

আন্তর্জাতিকতার গুরুত্ব নানান দিক থেকে অনুধাবন করা যায়, যেমন- 

[1] বিশ্বশান্তি মানবসভ্যতার সংরক্ষক:-  আন্তর্জাতিকতা আদর্শ আমাদের যুদ্ধহীন পৃথিবীর স্বপ্ন দেখায়, মানব সভ্যতাকে রক্ষা করে সমৃদ্ধির পথে চালিত করে। অধ্যাপক হ‍্যারল্ড ল‍্যাস্কির মতে, আন্তর্জাতিকতা আদর্শে আমাদের বাঁচতে হবে, নয়তো ধ্বংস অবশ্যম্ভাবী। বার্ট্রান্ড রাসেলের মতে, হয় মানুষ যুদ্ধ কে ধ্বংস করবে নয়তো যুদ্ধই মানুষকে নিশ্চিহ্ন করে দেবে।

[2] বিশ্বসমৃদ্ধির সহায়ক:-  আন্তর্জাতিকতা আদর্শ গ্রহণ করা হলে পৃথিবীতে যুদ্ধের কোনো প্রয়োজন থাকবে না। যুদ্ধে প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে সামরিক ব্যয়, অস্ত্রশস্ত্র নির্মাণ, বিশাল সেনাবাহিনীর রক্ষণাবেক্ষণ কোন কিছুই দরকার হবে না। এর ফলে যে পরিমাণ অর্থের সাশ্রয় হবে তাতে সমগ্র বিশ্ববাসী সুখে শান্তিতে বসবাস করতে পারবে।

[3] পারস্পরিক সহযােগিতার প্রসারক:-  বিশ্বে কোন রাষ্ট্র আজ আর বিচ্ছিন্ন ভাবে টিকে থাকতে পারবে না। মুক্ত বাণিজ্য নীতি, অবাধ পণ্য চলাচল, আর্থিক সংস্কার, সাংস্কৃতিক বিনিময়, বিশ্বায়ন ইত্যাদি কারণে রাষ্ট্রগুলি একে অন্যের উপর নির্ভরশীল। একমাত্র আন্তর্জাতিকতার পথেই বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থা উন্নততর পর্যায়ে উপনীত হতে পারে।

[4] জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্নতির সহায়ক:-  আন্তর্জাতিকতার আদর্শ রুপাই তাহলে পৃথিবীর নানা প্রান্তের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সংযোগ গড়ে উঠবে, ফলে জ্ঞান-বিজ্ঞানের অভাবনীয় উন্নতির পথ প্রশস্ত হবে।

5] উপনিবেশবাদ এবং নয়াউপনিবেশবাদের গতিরােধকারী:-  আন্তর্জাতিকতার আদর্শ গৃহীত হলে উপনিবেশবাদ ও নয়া উপনিবেশবাদ পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হতে পারে। আন্তর্জাতিকতা আদর্শে নতুন বিশ্ব রাষ্ট্র গঠিত হলে ছোট-বড় সমস্ত জাতিরাষ্ট্র সমমর্যাদার অধিকারী হতে পারে।

জাতীয়তাবাদ ও আন্তর্জাতিকতাবাদ এর মধ্যে সম্পর্ক


 জাতীয়তাবাদ ও আন্তর্জাতিকতাবাদ এর সম্পর্ক নির্ণয়ে বিজ্ঞানীরা একমত হতে পারেনি, যেখানে ল‍্যাস্কি, গার্নার, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমূখ মনে করতেন জাতীয়তাবাদ আন্তর্জাতিকতাবাদের পরিপন্থী। তারা জাতীয়তাবাদ ও আন্তর্জাতিকতাবাদ কি পরস্পর বিরোধী বলে মনে করেছেন। অন্যদিকে ম্যাৎসিনি, জিমার্ন, বার্ট্রাণ্ড রাসেল প্রমূখ সম্পূর্ণ ভিন্ন মত পোষণ করেছেন তাদের মতে জাতীয়তাবাদ ও আন্তর্জাতিকতাবাদ পরস্পর বিরোধী নয় বরং সহায়ক।

1) ধারণাগত স্বাতন্ত্র‍্য:- জাতীয়তাবাদ ও আন্তর্জাতিকতাবাদ এর সংজ্ঞা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, দুটি ধারণাই হল মানসিক অনুভূতি বা ভাবগত ধারণা বিশেষ। একটি জনসমাজের মধ্যে বংশ, ধর্ম, ভাষা ও সাহিত্য প্রকৃতির নানা কারণে গভীর একত্ববাদের প্রতিষ্ঠা করলে জাতীয়তাবোধের জন্ম হয়। জাতীয়তাবোধের সঙ্গে দেশপ্রেম মিলিত হয়ে জাতীয়তাবাদের সৃষ্টি হয়। অন্যদিকে বিভিন্ন জাতির স্বাতন্ত্র্যবোধ কে বিসর্জন না দিয়ে তাদের মধ্যে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাস্কৃতিক সহযোগিতার বন্ধনকে সুদৃঢ় করার মাধ্যমে স্বাধীনতা, সাম‍্য ও সৌভ্রাতৃত্বের ভিত্তিতে এক বিশ্বসমাজ গড়ে তোলাই আন্তর্জাতিকতাবাদের মুখ‍্য উদ্দেশ‍্য।

2)উগ্র বা বিকৃত জাতীয়তাবাদ আন্তর্জাতিকতা বাদের শুরু:- উগ্র বা বিকৃত জাতীয়তাবাদ মানবতা ও আন্তর্জাতিকতাবাদ এর বিরোধী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি, ইতালি ও জাপানের বিধ্বংসী ভূমিকা উগ্র জাতীয়তাবাদের এক জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। সংকীর্ণ জাত্যাভিমান অর্থাৎ নিজের জাতি অন্যসব জাতির থেকে শ্রেষ্ঠ-এই ধারণা ও অন্য জাতির প্রতি ঘৃণার মনোভাব বিকৃত জাতীয়তাবাদের জন্ম দেয়। এই বিকৃত জাতীয়তাবাদ কে দমন করতেই আন্তর্জাতিকতাবাদ এর সূত্রপাত হয়।

3)আদর্শ জাতীয়তাবাদ আন্তর্জাতিকতাবাদের পৃষ্ঠপোষক:- আদর্শ জাতীয়তাবাদ বিকৃত জাতীয়তাবাদের সম্পূর্ণ বিপরীত ধারণা। আদর্শ জাতীয়তাবাদ নিজের জাতিকে ভালবাসতে শেখায়, পাশাপাশি অন্য জাতিকে ভালোবাসার জন্য প্রেরণা জোগায়। আদর্শ জাতীয়তাবাদ নিজে বাঁচো এবং অপরকে বাঁচতে দাও এই বক্তব্য প্রচার করে আদর্শ জাতীয়তাবাদ বিশ্বসভ্যতার প্রগতিকে বাস্তবায়িত করেছে। তাই আদর্শ জাতীয়তাবাদের সঙ্গে আন্তর্জাতিকতাবাদের একটি সুসম্পর্ক রয়েছে।

 উপসংহার:- আন্তর্জাতিকতাবাদ এর কোন বিকল্প নেই। বস্তুতপক্ষে, অমানবিক যুদ্ধের আকাঙ্ক্ষা পৃথিবীর বুকে যত বেশি ঘনিয়ে আসবে, ততবেশি করে মানুষের মনে আন্তর্জাতিক আকাঙ্ক্ষা তীব্র হয়ে দেখা দেবে। তাই সংকীর্ণ স্বার্থের আঘাতে জর্জরিত পৃথিবীতে আন্তর্জাতিকতাবাদ আজ অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক।

জাতীয়তাবাদ ও আন্তর্জাতিকতাবাদ পরস্পর বিরোধী নয় বরং এরা একে অপরের পরিপূরক। আদর্শ জাতীয়তাবাদ হল আন্তর্জাতিকতা বাদের উত্তরণের অন্যতম সোপান। আদর্শ জাতীয়তাবাদকে বাদ দিয়ে আন্তর্জাতিক পরিবেশ গড়ে তোলা সম্ভব নয়। এই কারণে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জীমার্ন বলেছেন যে, জাতীয়তাবাদই হল আন্তর্জাতিকতায় উপনীত হবার রাজপথ।

No comments: