5.
রাষ্ট্রের উৎপত্তি-ঐশ্বরিক মতবাদমূল বক্তব্য:-রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কে যেসব কাল্পনিক মতবাদ চালু রয়েছে তার মধ্যে প্রাচীনতম হল ঐশ্বরিক মতবাদ।সেন্ট অগাস্টাইন,সেন্ট পল, রবার্ট ফিল্মমার হলেন এই মতবাদের প্রচারক।এই মতবাদের মূল বক্তব্য হল:
1)ঈশ্বর নিজে রাষ্ট্র সৃষ্টি করেছেন।ঈশ্বরের ইচ্ছানুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালিত হয়।
2)পৃথিবীতে ঈশ্বরের মনোনীত প্রতিনিধি হলেন রাজা।ঈশ্বরের যাবতীয় ইচ্ছা অনিচ্ছা রাজার মাধ্যমে কার্যকরী হয়।
3)রাজার আদেশ যা আইনরুপে পরিচিত তা আসলে ঈশ্বরের আদেশমাত্র।কাজেই রাজার আদেশ অমান্য করার অর্থ হল ঈশ্বরের আদেশ অমান্য করা।
4)রাজা যেহেতু ঈশ্বরের নির্দেশ ছাড়া অন্য কারো নির্দেশে কাজ করেন না, তাই রাজা কোনোরকম অন্যায় করতে পারেন না।
5)রাজা তার যাবতীয় কাজকর্মের জন্য শুধুমাত্র ঈশ্বরের কাছে দায়বদ্ধ থাকেন। রাজার কাজকর্মের জন্য জনগণ কোনভাবেই কৈফিয়ত চাইতে পারেন না।
6)রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষনা করার অর্থ ঈশ্বরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ।
চরম রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা:
ইউরোপে মধ্যযুগে ষোড়শ শতাব্দীতে ও সপ্তম শতাব্দীর প্রথমভাগে ধর্মগুরু পোপ ও রাজার মধ্যে ঈশ্বরের প্রতিনিধিত্বের প্রশ্নে প্রবল বিরোধিতার সূত্রপাত ঘটে। পোপ নিজেকে ঈশ্বরের এক এবং অদ্বিতীয় প্রতিনিধিরূপে পরিচয় দিয়ে জনগণের অখন্ড আনুগত্য দাবি করেন। সেন্ট টমাস একুইনাস রাষ্ট্রের পরিবর্তে চার্চকে সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ বলে মনে করতেন। মধ্যযুগের শেষ পর্বে প্রোটেস্ট্যান্ট আন্দোলনের ফলে পোপের প্রাধান্য খর্ব হয়। মার্টিন লুথার, ক্যালভিন প্রমূখ প্রোটেস্ট্যান্ট নেতৃবৃন্দ রাজাকে ঈশ্বরের একমাএ প্রতিনিধিরুপে তুলে ধরে জোরালো আন্দোলন করেন।
ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম জেমস শতাব্দীর শেষ দিকে রাজার অধীন রাষ্ট্রকে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ স্থান হিসেবে ঘোষণা করেন। তাঁর মতে, পৃথিবীতে ঈশ্বরের জীবন্ত প্রতিমূর্তি হলেন রাজা।
এইভাবে ঐশ্বরিক উৎপত্তিবাদ এক চরম রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করে।
[3] সমালােচনা: রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কে ঐশ্বরিক উৎপত্তিবাদের ব্যাখ্যাকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে সমালােচনা করা হয়—
অবাস্তব: সমালােচকদের মতে, ঐশ্বরিক শক্তির দ্বারা রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছে, এই ধারণা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কিত বাস্তবভিত্তিক যুক্তিগ্রাহ্য ধারণা এই মতবাদে উপেক্ষিত। রাষ্ট্রের মতাে একটি মানবীয় প্রতিষ্ঠান কীভাবে ঈশ্বর কর্তৃক সৃষ্ট হতে পারে, তার কোনাে যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা ঐশ্বরিক উৎপত্তিবাদ দিতে পারেনি।
অনৈতিহাসিক: রাষ্ট্র ঈশ্বর কর্তৃক সৃষ্ট এবং রাষ্ট্রের কর্ণধার রাজা হলেন ঈশ্বরের প্রতিনিধি ঐশ্বরিক উৎপত্তিবাদের এই মূল বক্তব্যের সমর্থন ইতিহাসে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। সুতরাং, ঈশ্বরের ইচ্ছার ফলে রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটেছে, এরকম ধারণা পুরােপুরি অনৈতিহাসিক।
অযৌক্তিক: সমালােচকদের মতে, ঈশ্বর করুণাময়, মানুষের কল্যাণে তিনি সদাজাগ্রত, তাই তাঁর প্রতিনিধি রাজা সর্বদা প্রজাদের কল্যাণে নিয়ােজিত থাকবেন—এটা ধরে নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু বাস্তবে বহু অত্যাচারী ও প্রজা-নিপীড়নকারী রাজার পরিচয় পাওয়া যায়। এই ধরনের অত্যাচারী রাজার কাজকে ঈশ্বরের ইচ্ছার অভিব্যক্তি বলে ধরে নিলে পরম করুণাময় ঈশ্বরের ধারণা কালিমালিপ্ত হতে বাধ্য।
অসম্পূর্ণ: শুধুমাত্র রাজতন্ত্রের ক্ষেত্রেই এই মতবাদ প্রযােজ্য, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র বা অন্য কোনাে ধরনের শাসনব্যবস্থার। উৎপত্তির প্রসঙ্গে এই মতবাদের আলােচনা গ্রহণযােগ্য নয়। তাই এই মতবাদ অসম্পূর্ণ।
অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরাচারী: রাজা যেহেতু ঈশ্বরের একমাত্র প্রতিনিধি তাই রাজার আদেশ সমস্ত সমালােচনার উধ্বে—এই ধরনের যুক্তি স্বৈরাচারের জন্ম দেয়। তা ছাড়া, এই মতবাদে রাজাকে তার কাজকর্মের জন্য শুধুমাত্র ঈশ্বরের কাছে দায়বদ্ধ থাকতে বলা হয়েছে। তিনি আর কারও কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য নন। এই মতবাদ রাজাকে আইনের ঊর্ধ্বে রেখে অগণতান্ত্রিকতা ও স্বৈরাচারিতাকে প্রশ্রয় দিয়েছে।
উপসংহার: ঐশ্বরিক উৎপত্তিবাদের কঠোর সমালােচনা সত্ত্বেও তত্ত্বটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব কোনােভাবেই অস্বীকার করা যায় না। অধ্যাপক গেটেলের মতে, স্বায়ত্তশাসনের জন্য মানুষ যখন আদৌ যােগ্য হয়ে ওঠেনি, তখন এই মতবাদ আনুগত্যের শিক্ষা দিয়েছিল (It taught men to obey when they were not yet ready to govern themselves)'। তা ছাড়া, রাষ্ট্র সৃষ্টির ক্ষেত্রে অন্যান্য উপাদানের পাশাপাশি ধর্মের যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে, তা ঐশ্বরিক মতবাদে স্বীকৃত হয়েছে।
No comments:
Post a Comment