12.
উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় স্বাধীনতা ও সাম্যের প্রকৃতি
স্বাধীনতা ও সাম্যের আদর্শ, সভ্য সমাজ গঠনের অন্যতম অপরিহার্য উপাদান। কিন্তু সব সমাজব্যবস্থায় স্বাধীনতা ও সাম্যের ধারণা প্রকৃতি একরকম হয় না। বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যবস্থায় স্বাধীনতা ও সাম্যের প্রকৃতি তারতম্য ঘটে। মার্কসীয় তত্ত্বানুসারে, স্বাধীনতা ও সাম্যের প্রকৃতি সমাজ ব্যবস্থার আর্থিক কাঠামো দ্বারা নির্ধারিত হয়। উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ ও হিতবাদের প্রভাব সুস্পষ্ট। এজন্য উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় স্বাধীনতা ও সাম্যের প্রকৃতি স্বতন্ত্র।
1)স্বাধীনতার প্রকৃতি:-উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও চিন্তার স্বাধীনতাকে দুটি মূলনীতি রূপে গ্রহণ করা হয়। স্বাধীনতার উপর সবরকম সরকারি বিধিনিষেধ ও নিয়ন্ত্রণ নিষিদ্ধ থাকে। উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নিয়ন্ত্রণ হীনতা স্বাধীনতার ধারনার একটি প্রধান উপাদান রূপে স্বীকৃত। মনে করা হয়, রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের অনুপস্থিতির মধ্যেই স্বাধীনতার প্রকৃত অস্তিত্ব নিহিত। সরকারি নিয়ন্ত্রণক্ষমতা যত কম, স্বাধীনতার পরিমাণ তত বেশি হয়। শুধুমাত্র রাজনৈতিক এবং কিছু সামাজিক স্বাধীনতা উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় স্বীকৃতি লাভ করে। অর্থনৈতিক স্বাধীনতাকে এখানে পুরোপুরি উপেক্ষা করা হয়। এজন্য উদারনৈতিক রাজনৈতিক ব্যবস্থায় স্বাধীনতা ধরোনা কে নেতিবাচক বলে। সাধারণত যেসব বিষয়ে স্বাধীনতা স্বীকৃতি পায় সেগুলির মধ্যে হলো-
মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা, নির্বাচন করা ও নির্বাচিত হওয়ার স্বাধীনতা, যে কোন পেশা বা বৃত্তি অবলম্বনে স্বাধীনতা, ধর্মীয় স্বাধীনতা, সরকারের সমালোচনা করার স্বাধীনতা প্রভৃতি। উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় স্বাধীনতার ধারণা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী দর্শনের উপর প্রতিষ্ঠিত। এই তত্ত্বানুসারে ব্যক্তিকে নিজের ইচ্ছা ও উদ্যোগ অনুসারে অবাধে চলতে দেয়া হল স্বাধীনতা।
👉সমালোচনা:-উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার রাজনৈতিক ও সামাজিক স্বাধীনতাগুলি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এগুলি হল অবাস্তব স্বাধীনতা। কারণ অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ছাড়া রাজনৈতিক ও সামাজিক স্বাধীনতা বাস্তবায়িত হতে পারে না। মার্কসবাদীদের মতে, উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে যে রাজনৈতিক স্বাধীনতা জনগণকে দেয়া হয়, তা শেষ পর্যন্ত মিথ্যায় পরিণত হয়। এই সমাজে স্বাধীনতা আসলে মুষ্টিমেয় মানুষের স্বাধীনতা মাত্র। লেনিনের মতে, বুর্জোয়া গণতন্ত্রে যে ব্যক্তি সাম্যের কথা বলা হয় তা আসলে সম্পত্তি-মালিকদের আইন সংগত সাম্য। এখানে প্রলেতারিয়েত শ্রেণি ও শোষিত শ্রেণীর কাছে সাম্য পৌঁছায় না।
2) সাম্যের প্রকৃতি:-উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সাম্যের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় স্বাধীনতার মতো এক্ষেত্রেও সামাজিক ও রাজনৈতিক সাম্যের আদর্শ প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করা হয়। তাছাড়া আইনের চোখে সবাই সমান এবং আইন কর্তৃক সমভাবে সংরক্ষিত হওয়ার কথা বলা হয়। এইভাবে আইনের অনুশাসন ও আইনের দৃষ্টিতে সাম্য প্রতিষ্ঠা করতে চাওয়া হয়। সমস্ত নাগরিকের ব্যক্তিত্ব বিকাশের জন্য রাষ্ট্র সমান সুযোগ দেয়ার কথা বলে থাকে। জাতি-ধর্ম-বর্ণ ও প্রতিপত্তি ভিত্তিতে রাষ্ট্র নাগরিকের মধ্যে কোন বিচার করে না। ধর্মীয় ক্ষেত্রেও সাম্য প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়। সর্বোপরি, সার্বিক প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকার এবং নাগরিকের নির্বাচিত হবার অধিকার স্বীকার করে রাজনৈতিক সাম্যের ধারণা কে বাস্তবায়নের চেষ্টা করা হয়।
👉 সমালোচনা:-উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শুধুমাত্র সামাজিক ও রাজনৈতিক সাম্যকে স্বীকৃতি দেয়া হয়। এখানে স্বামীর অন্য কোনো গুরুত্ব স্বীকৃতি পায় না। সমালোচকদের মতে, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সাম্য প্রতিষ্টিত না হলে রাজনৈতিক ও সামাজিক সাম্য মূল্যহীন হয়ে পড়ে। উদারনৈতিক ব্যবস্থায় অর্থনৈতিক সাম্যের স্বীকৃতি না থাকায় রাজনৈতিক ও সামাজিক সাম্যের সুযোগ থেকে সাধারণ মানুষ বঞ্চিত হয়।
উপসংহার:-উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় স্বাধীনতা ও সাম্যের প্রকৃতিকে পুরোপুরি মূল্যহীন বলে বর্ণনা করা উচিত নয়। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ও সাম্য প্রতিষ্ঠা সংক্রান্ত ব্যাপারে কিছু মৌলিক ব্যবস্থা ও এখানে দেখা যায়।
No comments:
Post a Comment