Tuesday, August 31, 2021

ন্যায় বিচারের বিভিন্ন রূপ ব‍্যাখ‍্যা করো।

 15. 

ন্যায় বিচারের বিভিন্ন রূপ

প্রাচীন গ্রিসে দার্শনিকদের রচনায় প্রথম ন্যায়বিচারের ধারণার সন্ধান পাওয়া যায়। প্লেটোর দ্য রিপাবলিক গ্রন্থে ন্যায় বিচারের উল্লেখ রয়েছে। আধ্যাত্মিক বা অধিবিদ্যা মূলক দৃষ্টিকোণ থেকে প্লেটো ন্যায় বিচারকে ব্যাখ্যা করেছেন। রোমান আইনবিদরা রাষ্ট্রীয় আইনকে চূড়ান্ত ন্যায়বিচারের অংশ বলে মনে করতেন। গণতান্ত্রিক  ধ্যানধারণার বিকাশের ফলে ন্যায়বিচার সম্পর্কিত ধারনার বদল ঘটেছে। আধুনিক গণতান্ত্রিক সমাজে ন্যায়বিচারের ধারণা ব্যক্তিজীবনের সমস্ত ক্ষেত্রে ব্যাপ্তি লাভ করেছে। তবে কিছু বিশেষ ক্ষেত্রে ন্যায় বিচারের রূপ খুব স্পষ্ট। সেইসব ক্ষেত্র অনুযায়ী ন্যায় বিচারকে চার ভাগে ভাগ করা হয়, যথা-

1) সামাজিক ন্যায়বিচার:- সামাজিক ন্যায়ের ধারণা অনুসারে, জনগণের সর্বাঙ্গীণ কল্যাণসাধনের উদ্দেশ্যে একটি ন্যায়সঙ্গত সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়। সামাজিক ন্যায়ের মাধ্যমে ব্যক্তিমানুষের স্বার্থের সঙ্গে সর্বসাধারণের স্বার্থের সমন্বয় ঘটানোর চেষ্টা করা হয়। প্রতিটি সমাজব্যবস্থাতেই ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের পূর্ণাঙ্গ বিকাশের জন্য ন্যূনতম সামাজিক সুযোগ সুবিধার মধ্যে সংগতি বিধান করা প্রয়োজন। এই ধরনের সুযোগ-সুবিধা উপভোগের ক্ষেত্রে সমস্ত মানুষের সমান অধিকারের কথা সামাজিক ন্যায়ে বলা হয়। বস্তুত সামাজিক সম্মানের সঙ্গে সামাজিক ন্যায় ধারণাটি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। একথা অনস্বীকার্য যে, বৈষম্যমূলক সমাজে কখনো সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনা। রাষ্ট্র বিজ্ঞানীদের মতে আইনের দৃষ্টিতে সাম্য, আইনের দ্বারা সমভাবে সংরক্ষণ, বিচারবিভাগীয় স্বাধীনতা প্রভৃতি ধারণা সামাজিক ন্যায়ের অন্তর্ভুক্ত।

2) রাজনৈতিক ন্যায়বিচার:- রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে, রাজনৈতিক ন‍্যায়ের একটি স্বতন্ত্র গুরুত্ব রয়েছে। সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের মানবাধিকার সংক্রান্ত ঘোষণায় 1948 খ্রিস্টাব্দে রাজনৈতিক ও সাম্যের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সাধারণভাবে রাজনৈতিক ন্যায় বলতে দেশের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় জনগণের সার্বিক অংশগ্রহণকে বোঝায়। এক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত স্বরূপ সার্বিক প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকারের কথা উল্লেখ করা যায়। উদারনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে রাজনৈতিক ন‍্যায়ের অর্থ হল নির্বাচিত করা ও নির্বাচিত হওয়ার অধিকারের সমতা, সরকারি পদ ও সরকারি চাকরি লাভের ক্ষেত্রে সমতা প্রভৃতি। রাজনৈতিক ন্যায়ের ধারণা অনুযায়ী রাজনৈতিক ক্ষমতার উৎস হল জনগণ। রাজনৈতিক ন‍্যায় জনগণের সার্বভৌমিকতার তত্ত্বকে তুলে ধরে। রাজনৈতিক ন‍্যায় রাষ্ট্রের মধ্যে রাজনৈতিক সাম্যের আদর্শকে প্রতিষ্ঠা করতে চায়। 3) অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার:- সামাজিক ন্যায়ের মত অর্থনৈতিক ন‍্যায়ও অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। অর্থনৈতিক ন্যায় ছাড়া সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠায় অর্থহীন। অর্থনৈতিক ন্যায়ের ধারণা প্রসঙ্গে মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি এবং উদারনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে বিস্তর প্রভেদ রয়েছে। উদারনীতিবিদরা অর্থনৈতিক ন‍্যায় বলতে রাষ্ট্রকর্তৃক জনকল্যাণমূলক কার্যক্রম রুপায়ন, গতিশীল কর ব্যবস্থার মাধ্যমে ধন বৈষম্য হ্রাস, উন্মুক্ত বাজার অর্থনীতি, অবাধ প্রতিযোগিতা প্রভৃতিকে বুঝিয়েছেন। অন্যদিকে, মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে, অর্থনৈতিক ন্যায় বলতে সমস্ত রকম ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও মালিকানার বিলোপ ঘটিয়ে উৎপাদনের উপকরণ এর উপর সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠাকে বোঝায়। অর্থাৎ অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার প্রসঙ্গে মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গীতে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি কায়েমের কথা বলা হয়। মার্কসের মতে, শ্রেনীহীন ও শোষনহীন সমাজ ছাড়া অর্থনৈতিক ন‍্যায় সম্ভব নয়।  

4)আইনগত ন্যায় বিচার:- আইনগত ন্যায় দেশের আইন প্রণয়নের কাঠামো ও বিচারব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত। আইনগত ন্যায়ের ধারণা অনুসারে, দেশের জন্য যুক্তিসঙ্গত আইন প্রণয়নের প্রয়োজন। অযৌক্তিক আইন প্রণীত হলে তা দেশের আইনগত ন্যায় এর পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এছাড়া আইনগত ন্যায় অনুযায়ী সকলের জন্য সমান আইন প্রণয়ন করা উচিত। আইনের দ্বারা সমভাবে সংরক্ষিত হওয়ার অধিকার প্রতিটি নাগরিকের থাকবে। আইনগত ন্যায়ের ধারণা অনুসারে আইন প্রণয়ন পদ্ধতি ন্যায়সঙ্গত হওয়া প্রয়োজন। অন্যায়, অযৌক্তিক বা জন বিরোধী আইন প্রণীত হলে জনগণ তার প্রতিবাদ করবেন। আইনগত ন্যায় একটি স্বাধীন, নির্ভীক ও নিরপেক্ষ বিচার ব্যবস্থা গড়ে তোলার কথা বলে। আইনসভা কর্তৃক প্রণীত আইনের যৌক্তিকতা বিচার করার জন্য বিচার বিভাগের হাতে বিচারবিভাগীয় সমীক্ষা ক্ষমতা থাকা প্রয়োজন। আইনগত ন্যায় অনুযায়ী, আইনের অনুশাসন দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় একান্ত অপরিহার্য।



No comments: