11.
জাতীয়তাবাদের পক্ষে যুক্তি
একটি সৃজনশীল ও রাষ্ট্রনৈতিক আদর্শ রূপে জাতীয়তাবাদের স্বতন্ত্র গুরুত্ব রয়েছে। কিন্তু জাতীয়তাবাদ শব্দটি একইসঙ্গে বিকৃত ও প্রকৃত জাতীয়তাবাদের সঙ্গে যুক্ত। প্রকৃত জাতীয়তাবাদ হল মানব মুক্তির অগ্রদূত। এর পক্ষে যুক্তি গুলি হল নিম্নলিখিত -
1) মহান আদর্শ :- এক মহান আদর্শ রূপে প্রকৃত জাতীয়তাবাদ সমগ্র জাতিকে দেশপ্রেমিক উদ্বুদ্ধ করে দেশের জন্য আত্মত্যাগ করতে অনুপ্রেরণা জোগায়। জাতীয়তাবাদী আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে পরাধীন জাতিগুলি মুক্তির জন্য আমরণ সংগ্রামে অনুপ্রাণিত হয়। ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের উৎখাত করার জন্য ভারতবাসীরা জাতীয়তাবাদী আদর্শে দীক্ষিত হয়েছিল।
2) গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সহায়ক:- ইউরোপের নবজাগরণের সময়ে যে জাতীয়তাবাদের জন্ম হয় তা পরবর্তীকালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও ফরাসি বিপ্লব সহ পৃথিবীর বহু দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে বাস্তবায়িত করতে সক্ষম হয়।
3) সম্প্রীতির প্রতীক:- প্রকৃত জাতীয়তাবাদের মূলমন্ত্র হলো "নিজে বাঁচো এবং অপরকে বাঁচতে দাও।" জাতীয়তাবাদ বিভিন্ন জাতির কাছে সংঘর্ষ ও সংঘাতের বদলে সহযোগিতা ও সম্প্রীতির বাণী পৌঁছে দেয়।
4) মানব সভ্যতার বিকাশে সহায়ক:- জাতীয়তাবাদের জনক ইটালির ম্যাৎসিনি মতে, আদর্শ জাতীয়তাবাদ পৃথিবীর বিভিন্ন জাতির অন্তর্নিহিত গুণাবলীর বিকাশ ঘটিয়ে মানব সভ্যতাকে সমৃদ্ধ ও বিকশিত হতে সাহায্য করে।
5) স্থায়িত্ব ও শান্তির সহায়ক:- জাতীয়তাবাদী আদর্শে উদ্বুদ্ধ জনসমাজস্বশাসন প্রতিষ্ঠা করায় শাসক ও শাসিতের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। জনগণের মধ্যে পারস্পরিক বিদ্বেষ, হানাহানি, অবিশ্বাস ইত্যাদি না থাকায় দেশের শাসন ব্যবস্থায় স্থায়িত্ব আসে এবং শান্তির অনুকূল পরিবেশ গড়ে ওঠে।
6) যুদ্ধের সম্ভাবনা হ্রাসকারী:- আদর্শ জাতীয়তাবাদ পৃথিবীর বিভিন্ন জাতির মধ্যে যে সহযোগিতা ও সৌভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে, তার ফলে জাতিগুলির মধ্যে পারস্পরিক বৌরী মনোভাব বিনষ্ট হয়। সেই জন্য যুদ্ধ বা যুদ্ধ সংক্রান্ত আকাঙ্ক্ষা দূর হয়।
7) আন্তর্জাতিকতা বাদের সোপান:- জিম্যানের মতে, জাতীয়তাবাদ হলো আন্তর্জাতিকতাবাদের পৌঁছানোর এক প্রশস্ত সরণি। বর্তমান বিশ্বে প্রতিটি রাষ্ট্র নিজে বাঁচো এবং অপরকে বাঁচতে দাও এই জাতীয়তাবাদী আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে যে পারস্পরিক সদ্ভাব ও মৈত্রীর বাতাবরণ গড়ে তোলে তারফলে আন্তর্জাতিকতার পথ প্রশস্ত হয়।
জাতীয়তাবাদের বিপক্ষে যুক্তি
জাতীয়তাবাদ শব্দটি একই সঙ্গে প্রকৃত ও বিকৃত জাতীয়তাবাদের সঙ্গে যুক্ত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার হিটলারের জার্মানি হল এই জাতীয়তাবাদের একটি দৃষ্টান্ত। হায়েসের মতে, উগ্র জাতীয়তাবাদ হল চরম অন্যায় ও অকল্যাণের প্রধান উৎস। রবীন্দ্রনাথ একে মানব সভ্যতার শত্রুরূপে চিহ্নিত করেছিলেন। এর বিপক্ষে যুক্তি গুলি হল-
1) সাম্রাজ্যবাদের জনক:- বিকৃত জাতীয়তাবাদকে সাম্রাজ্যবাদের জনক রূপে অভিহিত করা হয়। ঊনবিংশ শতাব্দীতে এক সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদী উন্মাদনায় ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তি এশিয়া আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার তথা তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে সাম্রাজ্যবাদ বিস্তারে সচেষ্ট হয়েছিল।
2) জাতিবিদ্বেষ এর জনক:- বিকৃত জাতীয়তাবাদের প্রবক্তারা শুধুমাত্র নিজের জাতিকে শ্রেষ্ঠ বলে মনে করেন। অন্য জাতির কৃষ্টি ও সভ্যতার প্রতি ঘৃণার মনোভাব জাতিবিদ্বেষ এর জন্ম দেয়।
3) সুস্থ সংস্কৃতির পরিপন্থী:- বিকৃত বা উগ্র জাতীয়তাবাদ সর্বদা নিজের সংস্কৃতিকে সর্বশেষ্ঠ বলে মনে করে, এমনকি নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য তার অপরের সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে ধ্বংস করতে কুণ্ঠাবোধ করে না।
4) গণতন্ত্র হত্যাকারী:- বিকৃত জাতীয়তাবাদের শাসনকালে কোন বিরোধী পক্ষকে জীবিত রাখা হয়না যাবতীয় বিরোধিতাকে কঠোর হস্তে দমন করা হয়, বিরোধী কণ্ঠ স্তব্ধ করে দেওয়া হয়।
5) সাংস্কৃতিক স্থবিরতার জন্মদাতা:- বিকৃত জাতীয়তাবাদ এর ফলে জাতীয় রাষ্ট্র ও অন্যান্য জাতির উন্নত সংস্কৃতির কাছ থেকে যা কিছু শিক্ষনীয় তা সব বিসর্জন দেয়। এই উন্নাসিক মানসিকতার ফলে একটি জাতির সাংস্কৃতিক স্থবিরতা শিকার হয়।
6) বিশ্ব শান্তির বিরোধী :- বিকৃত জাতীয়তাবাদের জনক মুসোলিনি বিশ্বশান্তির প্রচেষ্টাকে কাপুরুষের স্বপ্ন ব্যঙ্গ করেছিল। বিংশ শতাব্দীতে যে দুটি বিশ্বযুদ্ধ সংঘটিত হয় তা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় দুটি যুদ্ধেই বিকৃত জাতীয়তাবাদী নেতৃবৃন্দ মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিল।
7)আন্তর্জাতিকতার বিরোধী:- মার্কসবাদীদের মতে, জাতীয়তাবাদ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন চেহারায় আবির্ভূত হয়ে শুধুমাত্র শোষকশ্রেণীর স্বার্থের সহায়ক হিসাবে কাজ করেছে। এই ধরনের সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের সোপান বেয়ে কখনোই আন্তর্জাতিকতার প্রশস্ত আঙিনায় পৌঁছানো যায় না।
উপসংহার:- আদর্শ হিসেবে জাতীয়তাবাদ সবসময়ই মানবকল্যাণের অগ্রদূত। সব ধরনের সংকীর্ণতা থেকে মুক্ত যুক্তিনির্ভর প্রকৃত জাতীয়তাবাদ মানবজাতির সার্বিক উন্নয়ন এর পক্ষে খুবই প্রয়োজনীয়। কিন্তু এই জাতীয়তাবাদী যখন সংকীর্ণ বা আগ্রাসীর রূপ নেয়, তখন তা সমগ্র মানব সভ্যতার কাছেই বিপদের হয়ে দাঁড়ায়। জাতীয়তাবাদ বিকৃত রূপ ধারণ করলে মানব কল্যাণের পথ রুদ্ধ হয়। বিশ্ব শান্তি বিনষ্ট হয়। ধরনের বিকৃত জাতীয়তাবাদ কি নিঃসন্দেহে মানব সভ্যতার শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। বস্তুত, জাতীয়তাবাদ কিভাবে ব্যবহৃত হবে তার উপরে নির্ভর করে তার কল্যাণকর ও অকল্যাণকর ভূমিকা।
No comments:
Post a Comment