8.
হবস, লক এবং রুশাের তত্ত্বের তুলনামূলক আলোচনা
সামাজিক চুক্তি মতবাদের প্রধান তিন প্রবক্তা হলেন ইংরেজ দার্শনিক হবস, লক এবং ফরাসি দার্শনিক রুশাে।
হবস, লক এবং রুশাের তত্ত্বের সাদৃশ্য
হবস, লক ও রুশাে তিনজনই তাদের তত্ত্বে সামাজিক চুক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্র সৃষ্টির কথা বলেছেন| হবস, লক এবং রুশাের তত্ত্বে এ কথা স্বীকার করা হয়েছে যে, রাষ্ট্রের উদ্ভব হওয়ার আগে মানুষ প্রকৃতির রাজ্যে বাস করত। প্রাকৃতিক অবস্থায় বসবাস করার সময় মানুষ যেসব বাধাবিপত্তির সম্মুখীন হয়েছিল, তা দূর করার জন্য এবং জীবন, স্বাধীনতা ও সম্পত্তির নিরাপত্তার লক্ষ্যে তারা রাষ্ট্র গঠনের জন্য উদ্যোগী হয়।
হবস, লক এবং রুশাের তত্ত্বের বৈসাদৃশ্য
হবস, লক এবং রুশাে—এই তিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর তত্ত্বের মধ্যে সাদৃশ্য বা মতৈক্যের পাশাপাশি বহু বিষয়ে বৈসাদৃশ্য বা মতানৈক্য দেখা যায়—
[1] উদ্দেশ্য: হবস নিজে ইংল্যান্ডের স্বৈরাচারী স্টুয়ার্ট রাজপরিবারের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এজন্য তিনি সামাজিক চুক্তি মতবাদে রাজার হাতে চরম ক্ষমতা তুলে দিয়েছিলেন। এমনকি স্বৈরাচারী হলেও রাজার বিরুদ্ধে কোনাে বিদ্রোহ ঘােষণা করা যাবে না বলে তিনি মন্তব্য করেন। অন্যদিকে, ব্রিটিশ দার্শনিক লকের মতবাদে নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্রের প্রতি সমর্থন লক্ষ করা যায়। ফরাসি দার্শনিক রুশাে তাঁর মতবাদে সামাজিক চুক্তির মাধ্যমে সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার আদর্শের ওপর ভিত্তি করে একটি প্রকৃত গণতান্ত্রিক সমাজ গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন।
[2] সার্বভৌমত্বের অবস্থান: হবসের তত্ত্বে রাজাকে চরম ক্ষমতার অধিকারীরূপে বর্ণনা করা হয়েছে। হবস ব্যক্তিসংসদের হাতে চরম ক্ষমতা তুলে দিয়ে আইনগত সার্বভৌমিকতার কথা বলেছেন। লকের তত্ত্বে এ কথা স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, কর্তব্যচ্যুত রাজাকে সিংহাসনচ্যুত করার পূর্ণ অধিকার জনগণের রয়েছে। এভাবে লক তাঁর তত্ত্বে 'রাজনৈতিক সার্বভৌমিকতার ধারণার জন্ম দেন। অন্যদিকে, ফরাসি দার্শনিক রুশাে সাধারণ ইচ্ছা-কে চূড়ান্ত, অভ্রান্ত, অবিভাজ্য ও অহস্তান্তরযােগ্য বলে অভিহিত করেন। এইভাবে রুশাে জনগণের সার্বভৌমিকতার কথা তুলে ধরেন।
[3] আইন: হবসের বক্তব্য অনুযায়ী রাজার নির্দেশই হল আইন। তাঁর মতে, আইন চরম ও অভ্রান্ত। এই কারণে আইনের বিরােধিতা করা উচিত নয়। লকের অভিমত হল, আইনের মাধ্যমে জনগণের জীবন, সম্পত্তি ও স্বাধীনতা রক্ষা করা রাজার কর্তব্য। রাজা শুধুমাত্র এই কর্তব্যপালনের বিনিময়ে প্রজাদের আনুগত্য লাভ করে থাকেন। রুশাের মতে, আইন হল সমষ্টিগত ইচ্ছার প্রকাশ। তাঁর মতে, আইনের বিরােধিতা করা ঠিক নয়। কারণ, আইনের বিরােধিতার অর্থ হল নিজেদের সমষ্টিগত ইচ্ছার বিরােধিতা করা।
[4] চুক্তির স্বরূপ: হবসের বক্তব্য অনুসারে, আদিম মানুষ নিজেদের মধ্যে একটি চুক্তি করে যাবতীয় ক্ষমতা কোনাে ব্যক্তি বা ব্যক্তিসংসদের হাতে তুলে দিয়েছিল। রাজা নিজে চুক্তির ঊর্ধ্বে ছিলেন| তিনি চুক্তির কোনাে পক্ষে ছিলেন না। অন্যদিকে, লকের মতে চুক্তি হয়েছিল দুটি। প্রথমে জনগণ নিজেদের মধ্যে একটি চুক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্রের সৃষ্টি করে এবং পরে দ্বিতীয় চুক্তিটির মাধ্যমে জনগণ তাদের সমস্ত ক্ষমতা রাজার হাতে তুলে দেয়। রুশাের মতে আদিম মানুষ চুক্তির সাহায্যে রাষ্ট্র তৈরি করেছিল ঠিকই, কিন্তু এই চুক্তি হয়েছিল জনগণের নিজেদের মধ্যে৷রুশাের বক্তব্য হল চুক্তির মাধ্যমে জনগণ তাদের সমস্ত ক্ষমতা 'সাধারণ ইচ্ছা'-র হাতে তুলে দিয়েছিল।
[5] চুক্তির আবশ্যিকতা: হবসের বক্তব্য ছিল, আদিম মানুষ তাদের দুর্বিষহ জীবন থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য চুক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্রের সৃষ্টি করেছিল৷ লকের মতে, প্রাকৃতিক অবস্থায় আদিম মানুষের জীবন ছিল অসম্পূর্ণ। এই অবস্থায় আদিম মানুষ চুক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্রের সৃষ্টি করে। রুশাের মতে, প্রাকৃতিক অবস্থায় জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং ব্যক্তিগত ধনসম্পত্তির আবির্ভাবের ফলে যে সমস্ত জটিলতা দেখা দেয়, তার ফলে আদিম মানুষের জীবনের সুখস্বাচ্ছন্দ্য নষ্ট হয়ে যায়, ধনী-দরিদ্রের মধ্যে সংঘাত ও যুদ্ধবিগ্রহ দেখা দেয়। এই অসহনীয় অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য মানুষ চুক্তির মাধ্যমে সার্বভৌম শক্তির প্রতিষ্ঠা করে।
[6] সামাজিক পরিস্থিতি: হবসের বক্তব্য হল রাষ্ট্র সৃষ্টির পূর্বে মানুষ প্রাকৃসামাজিক পরিবেশে বসবাস করত। অর্থাৎ, তখনও পর্যন্ত সমাজের আবির্ভাব ঘটেনি। লকের মতে, প্রাকৃতিক অবস্থায় রাষ্ট্র সৃষ্টি না হলেও সমাজ সৃষ্টি হয়েছিল। তবে আদিম মানুষের সমাজে তখনও কোনাে রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষ ঘটেনি। রুশাের অভিমত হল, প্রাকৃতিক অবস্থার প্রথম পর্বে মানুষ সম্পূর্ণ স্বাধীন ছিল। তাঁর মতে, এই প্রাসামাজিক পরিবেশে আদিম মানুষের সমাজে সাম্য প্রতিষ্ঠিত ছিল।
[7] প্রাকৃতিক অবস্থায় মানবজীবন: হবসের মতে, প্রকৃতির রাজত্বে কোনােপ্রকার বলবৎযোগ্য আইনকানুন না থাকার ফলে মানুষ এক অনিয়ন্ত্রিত ও স্বেচ্ছাচারী জীবনযাপন করত। অন্যদিকে লকের বক্তব্য হল, প্রাকৃতিক অবস্থায় সমাজজীবনের অস্তিত্ব থাকায় মানুষের জীবনযাত্রা প্রকৃতির নিয়মকানুনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হত। রুশাের মতে, প্রকৃতির রাজত্বে মানবসমাজে কলহ, বিবাদ, হিংসা, দ্বেষ ইত্যাদি দেখা যায়নি।
[8] প্রাকৃতিক অবস্থা: আদিম মানুষ প্রাকৃতিক অবস্থায় কী পরিস্থিতিতে ছিল তার ব্যাখ্যা প্রদানের ক্ষেত্রে তিনজনের মধ্যে মতপার্থক্য লক্ষ্য করা যায়।হবসের মতে, প্রাকৃতিক অবস্থায় মানুষ ছিল ঘৃণ্য, লােভী, নিষ্ঠুর ও পাশবিক। আদিম মানুষের মধ্যে ছিল দ্বন্দ্ব, কলহ ইত্যাদি। এককথায় প্রাকৃতিক অবস্থায় ছিল 'জোর যার মুলুক তার'। লকের মতে, প্রাকৃতিক অবস্থায় মানুষের মধ্যে দ্বন্দ্ব বা কলহ ছিল না। আদিম মানুষ স্বাভাবিক অধিকার ভােগ করত এবং স্বাভাবিক আইন দ্বারা পরিচালিত হত। রুশাের মতে, প্রাকৃতিক অবস্থা ছিল 'মর্ত্যের স্বর্গ'। প্রাকৃতিক অবস্থায় আদিম মানুষ ছিল পাখির মতাে স্বাধীন।
[9] চুক্তির কারণ: হবসের মতে, আদিম মানুষ প্রাকৃতিক অবস্থার নিঃসঙ্গ ও দুর্বিষহ জীবন থেকে মুক্তির জন্য চুক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্র গড়ে তােলে। লকের মতে, স্বাভাবিক আইনকে ব্যাখ্যা ও বলবৎ করার মতাে কোনাে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ না থাকায় প্রাকৃতিক অবস্থার সুখশান্তি অশান্তিতে পরিণত হয়। এর থেকে মুক্তির জন্য আদিম মানুষ চুক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্র গড়ে তােলে। রুশাের মতে, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, মুক্তির উন্মেষ ও ব্যক্তিগত সম্পত্তির উদ্ভব—এই তিনটি কারণে প্রাকৃতিক অবস্থার সুখশান্তি বিনষ্ট হয়। ফলে আদিম মানুষ চুক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্র গড়ে তােলে।
[10] চুক্তির সংখ্যা: হবস এবং রুশাের মতে, চুক্তি হয়েছিল একটি, কিন্তু লক দুটি চুক্তির কথা বলেছেন। হসের মতে, আদিম মানুষ শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য নিজেদের মধ্যে চুক্তি করে তাদের সমস্ত ক্ষমতা নিঃশর্তভাবে রাজার হাতে অর্পণ করে। লকের মতে, আদিম মানুষ প্রথমে নিজেদের মধ্যে চুক্তি করে এবং পরে রাজা বা কোনাে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে চুক্তি করে তাদের ক্ষমতার কিছু অংশ এই শর্তে অর্পণ করে যে, কর্তৃপক্ষ জনগণের স্বাভাবিক অধিকার রক্ষা করবে। রুশাের মতে, আদিম জনগণ চুক্তির মাধ্যমে তাদের ক্ষমতা কোনাে কর্তৃপক্ষের হাতে অর্পণ না করে, সাধারণের ইচ্ছার কাছে অর্পণ করে।
[11] চুক্তির ফলাফল: হবস বর্ণিত চুক্তির ফলে জন্ম নেয় চরম রাজতন্ত্র, যা স্বৈরতন্ত্রেরই নামান্তর। লক বর্ণিত চুক্তির ফলে জন্ম নেয় সীমাবদ্ধ রাজতন্ত্র। অর্থাৎ, সরকার জনগণের অধিকার রক্ষায় ব্যর্থ হলে জনসাধারণ সরকারের পরিবর্তন করতে পারবে। রুশাে বর্ণিত চুক্তির ফলে জনসাধারণই সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী হয়। অর্থাৎ, রুশাে প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের কথা বলেন।
[12] অধিকার: হবস জনসাধারণের কোনাে অধিকারকে স্বীকার করেননি। লক জনসাধারণের স্বাভাবিক অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়েছেন। তিনি জীবন, স্বাধীনতা ও সম্পত্তির অধিকারকে স্বাভাবিক অধিকার বলেছেন। রুশাে তার সাধারণ ইচ্ছা তত্ত্বের মাধ্যমে এই ধারণা প্রতিষ্ঠিত করেছেন যে, স্বাধীনতা মানুষের জন্মগত অধিকার।
[13] রাষ্ট্র ও সরকার: হবস রাষ্ট্র ও সরকারের মধ্যে কোনােরূপ পার্থক্য করেননি। কিন্তু লক ও রুশাে রাষ্ট্র এবং সরকারের মধ্যে পার্থক্য নির্দেশ করেছেন।
মূল্যায়ন: হবস, লক ও রুশাে তিনজনই একমত যে চুক্তির মাধ্যমেই রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছে। অর্থাৎ, তিনজনই হলেন চুক্তিবাদী। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাদের রচনায় সাদৃশ্য অপেক্ষা বৈসাদৃশ্যই বেশি।
No comments:
Post a Comment