Tuesday, August 31, 2021

জাতীয় জনসমাজের সংজ্ঞা দাও। জাতীয় জনসমাজ গঠনের মূল উপাদান গুলি আলোচনা করো। জাতীয় জনসমাজ বলতে কী বুঝায়? জাতীয় জনসমাজ গঠনের ক্ষেত্রে যেসব উপাদানগুলি কাজ করে সেগুলির বিবরণ দাও।

 1.

জাতীয় জনসমাজ



    জাতীয় জনসমাজ (Nationality) হল জনসমাজ (People) জাতির (Nation) মধ্যবর্তী পর্যায়। সাধারণভাবে বলা যায়, যখন কোনাে জনসমাজ রাজনৈতিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে অন্যান্য জনসমাজ থেকে নিজেদের সম্পূর্ণ আলাদা বলে ভাবতে থাকে, তখন সেই জনসমাজ জাতীয় জনসমাজে পরিণত হয়



    জন স্টুয়ার্ট মিল রাজনৈতিক চেতনাসম্পন্ন জনসমাজকে জাতীয় জনসমাজ আখ্যা দিয়েছেন। লর্ড ব্রাইসের মতে, জাতীয় জনসমাজ বলতে এমন এক জনসমাজকে বােঝায় যারা শতাব্দীব্যাপী ভাষা, সাহিত্য, ধ্যানধারণা, রীতিনীতি ঐতিহ্যের বন্ধনে দৃঢ়ভাবে আবদ্ধ এবং যারা অনুরূপভাবে আবদ্ধ অন্য কোনাে জনসমাজ থেকে নিজেদের স্বতন্ত্র বলে মনে করে থাকে। ম্যাকাইভার জাতীয় জনসমাজ বলতে সম্প্রদায়ের সামাজিক ঐক্যবােধকে বুঝিয়েছেন। কোকার মনে করেন, জাতীয় জনসমাজ হল প্রধানত অতীত ইতিহাসের অভিজ্ঞতা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ফলাফল

    তাই বলা যায় যে জাতীয় জনসমাজ হলো নির্দিষ্ট ভূখন্ড বসবাসকারী রাজনৈতিক চেতনা সম্পন্ন জনসমাজকে যারা
ভাষা ধর্ম বংশ কৃষ্টি ঐতিহ্যগত ক্ষেত্রে একাত্মতার বন্ধনে আবদ্ধ 

জাতীয় জনসমাজের মূল উপাদান

যে সমস্ত উপাদানের দ্বারা কোন সমাজ জাতীয় জনসমাজের স্হান নিতে পারে সেই সমস্ত উপাদানকে জাতীয় জনসমাজের মূল উপাদান বলা হবে।   রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা জাতীয় জনসমাজ গঠনের উপাদানগুলিকে দুটি ভাগে ভাগ করেছেন।যথা:-বাহ‍্যিক বা বস্তুগত উপাদান ও ভাবগত উপাদান।



[1] বাহ্যিক বা বস্তুগত উপাদান: এগুলি হল

1)ভৌগােলিক একতা:-কোন স্থানে সুদীর্ঘকাল বসবাসের জন্য জনসমষ্টির মধ্যে এক গভীর একাত্মবোধের জন্ম দেয়।

📌ব‍্যতিক্রম:- ইহুদির ইজরায়েল রাষ্ট্র যেখানে ভৌগলিক এলাকা কিন্তু এতৎসত্তেও একাত্মবোধ দেখা মেলে।

2)বংশগত ঐক্য:-কোন জনসমাজের অন্তর্গত মানুষ নিজেদের একই বংশের মানুষ মনে করলে তাদের মধ্যেও একাত্মবোধ গড়ে ওঠে ফলে জাতীয়তাবোধের জন্ম দেয়।

📌ব‍্যতিক্রম:- ব্রিটিশ, ফরাসি, মার্কিন ও ভারতীয়দের মধ্যে কোনো বংশগত ঐক‍্য নেই।

3)ভাষাগত ঐক্য:- একই ভাষাভাষীর মানুষ সুদীর্ঘকাল একসাথে থাকার জন‍্য তাদের মধ্যেও ভাষাগত ঐক‍্যের একাত্মবোধ গড়ে ওঠে।

📌ব‍্যতিক্রম:- ভারতের জনগোষ্ঠী বহুভাষাভাষী হওয়া সত্বেও ভাষাগত ঐক্য দেখা মেলে।

4)ধর্মগত ঐক্য:-একই ধর্মের মানুষদের মধ্যে সমধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান ও উপাসনার দরুণ গভীর একাত্মবোধ জন্ম নেয়।

5)রাষ্ট্রনৈতিক ঐক্য :- দীর্ঘকালব্যাপী কোন জনসমষ্টি একই সরকারের অধীনে থাকলে তাদের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই ঐক্যবোধের সৃষ্টি হয়। দৃষ্টান্ত স্বরূপ, ব্রিটিশ শাসনাধীনে থাকা ভারতবর্ষের কথা উল্লেখ করা যায়।

6)অর্থনৈতিক সমস্বার্থ:- জাতীয় জনসমাজ গঠনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো একই ধরনের অর্থনৈতিক স্বার্থের বন্ধন। অর্থনৈতিক স্বার্থের অভিন্নতা জনগোষ্ঠীকে বিপ্লবে শামিল করেছেন এমন দৃষ্টান্ত ইতিহাসে অনেক আছে। সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশদের অর্থনৈতিক শোষণের বিরুদ্ধে ভারতীয়দের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের কথা এক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লেখ করা যায়।



[2] ভাবগত উপাদান: জাতীয় জনসমাজ গঠনের ক্ষেত্রে শুধু বাহ্যিক বা বস্তুগত উপাদানই যথেষ্ট নয়, ভাবগত ঐক্যও অপরিহার্য। জাতীয় জনসমাজ গঠনে ভাবগত উপাদানই হল মূল ঐক্যবিধানকারী শক্তি (cementing factor) ফরাসি রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রেনার মতে, জাতীয় জনসমাজ-সম্পর্কিত ধারণা হল প্রধানত একটি ভাবগত ধারণা। কোনাে জনসমাজ যখন ভাবে যে তাদের সুখ-দুঃখ, ব্যথা-বেদনা, আশা-আকাঙ্ক্ষা, গৌরব-গ্লানি সব এক, তখন সেই জনসমাজের চেতনায় জাতীয়তাবােধের সঞ্চার ঘটে

 উপসংহার:-পরিশেষে বলা যায় যে, জাতীয় জনসমাজ গঠনের জন্য বাহ‍্যিক উপাদান ও ভাবগত উপাদানের মধ্যে কোন একটি মাত্র উপাদান জাতি গঠনের ক্ষেত্রে অপরিহার্য নাও হতে পারে, উভয় উপাদানের মিলিত ভূমিকা অনেক সময় সমান গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে।

No comments: