7.
চুক্তিবাদী রাষ্ট্রতান্ত্রিক: টমাস
হবস, জন লক এবং জ্যা জ্যাক রুশাে
তিনজনই
একমত
যে, চুক্তির মাধ্যমেই রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছে। অর্থাৎ
তিনজনই
চুক্তিবাদী।
রাষ্ট্রের উৎপত্তি
সংক্রান্ত সামাজিক
চুক্তি
মতবাদ
রাষ্ট্রের উৎপত্তি
সম্পর্কে
প্রচলিত
কাল্পনিক
মতবাদগুলির মধ্যে
সবথেকে
গুরুত্বপূর্ণ ও আলােচিত মতবাদ হল সামাজিক
চুক্তি
মতবাদ।
[1] মূল বক্তব্য:
সুদূর
অতীতে
মানবসমাজে রাষ্ট্র
ও সরকারের কোনাে অস্তিত্ব ছিল না। সেসময় মানুষের
মধ্যে
কোনো
রাজনৈতিক
চেতনাও
সৃষ্টি
হয়নি।
রাষ্ট্রহীন সেই অবস্থাকে প্রাকৃতিক অবস্থা বা 'State of Nature' বলে অভিহিত
করা হয়। চুক্তিবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে
কয়েকজনের মতে, প্রাকৃতিক অবস্থায় সমাজের সৃষ্ট হয়নি।
এই অবস্থা ছিল 'Pre-Social' বা প্রাকসামাজিক চুক্তিবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের অন্য
একদল
মনে করেন, এই অবস্থায়
সমাজের
অস্তিত্ব
থাকলেও
রাষ্ট্রের কোনাে
অস্তিত্ব
ছিল না৷ একে তাঁরা
প্রাকৃরাষ্ট্রীয় বা
Pre-State বলে আখ্যায়িত করেন। যাই হােক,
এই প্রাকৃতিক অবস্থায় মানুষের জীবনযাপন প্রাকৃতিক আইন দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হত। ক্রমশ প্রাকৃতিক অবস্থায়
মানুষের
জীবন
দুর্বিষহ
এবং অসহনীয় হয়ে ওঠে। এই অবস্থা থেকে মুক্তি
পাওয়ার
লক্ষ্যে
আদিম
মানুষ
স্বেচ্ছায় পারস্পরিক চুক্তির
মাধ্যমে
রাষ্ট্র
গড়ে
তােলে।
[2] প্রধান প্রবক্তা:
চুক্তির
মাধ্যমে
রাষ্ট্র
সৃষ্টির
ধারণা
নতুন
নয়৷
মহাভারতের শান্তিপর্বে, কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে, সফিস্টদের বক্তব্যে,
বাইবেল-এর ওল্ড টেস্টামেন্টে সামাজিক
চুক্তি
মতবাদের
উল্লেখ
পাওয়া
যায়।
তবে মূলত যে তিনজন
রাষ্ট্রদার্শনিক এই মতবাদকে সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করেন তাঁরা হলেন,
সপ্তদশ
শতাব্দীর
ইংরেজ
রাষ্ট্রচিন্তাবিদ টমাস
হবস ও জন লক এবং অষ্টাদশ শতাব্দীর
ফরাসি
চিন্তাবিদ জা জ্যাক রুশাে।রুশাের মতবাদ: ১৭৬২ সালে ফরাসি
দার্শনিক
জা জ্যাক রুশাে সােশ্যাল
কনট্রাক্ট (Contract Social বা Social Contract) নামক গ্রন্থে
এই অভিমত ব্যক্ত করেন
যে, মানুষের প্রাক্রাষ্ট্রীয় জীবন ছিল সুখী,
সরল ও আনন্দময়। কিন্তু
জনসংখ্যা
বৃদ্ধি
ও ব্যক্তিগত সম্পত্তির উদ্ভবের ফলে যে সমস্যার
সৃষ্টি
হল তাতে মানুষের জীবন
দুর্বিষহ
হয়ে
ওঠে।
এই অবস্থা থেকে মুক্তি
পাওয়ার
জন্য
সামাজিক
চুক্তির
মাধ্যমে
মানুষ
রাষ্ট্রব্যবস্থা সৃষ্টি
করে সুসংবদ্ধ সমাজব্যবস্থা গড়ে তােলে। রুশাের
মতে, কোনাে বিশেষ ব্যক্তি
বা ব্যক্তিসংসদের সঙ্গে মানুষ সামাজিক
চুক্তি
করেনি,
জনগণ
নিজেদের
মধ্যে
এই চুক্তি সম্পাদন করে সার্বভৌম ক্ষমতা সাধারণ ইচ্ছা-র (General Will) হাতে তুলে দেয়।
·
·
রুশাের মতবাদ: ১৭৬২ সালে ফরাসি দার্শনিক জা জ্যাক রুশাে সােশ্যাল কনট্রাক্ট
(Contract Social বা Social Contract) নামক গ্রন্থে এই অভিমত ব্যক্ত করেন যে,
মানুষের প্রাক্রাষ্ট্রীয় জীবন ছিল সুখী,
সরল ও আনন্দময়। কিন্তু জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও ব্যক্তিগত সম্পত্তির উদ্ভবের ফলে যে সমস্যার সৃষ্টি হল তাতে মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। এই অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য সামাজিক চুক্তির মাধ্যমে মানুষ রাষ্ট্রব্যবস্থা সৃষ্টি করে সুসংবদ্ধ সমাজব্যবস্থা গড়ে তােলে। রুশাের মতে,
কোনাে বিশেষ ব্যক্তি বা ব্যক্তিসংসদের সঙ্গে মানুষ সামাজিক চুক্তি করেনি,
জনগণ নিজেদের মধ্যে এই চুক্তি সম্পাদন করে সার্বভৌম ক্ষমতা সাধারণ ইচ্ছা-র
(General Will) হাতে তুলে দেয়।
·
জন লকের মতবাদ: ১৬৯০ সালে প্রকাশিত টু ট্রিটিজেস অব গভর্নমেন্ট
(Two Treatises of Government) গ্রন্থে ব্রিটিশ চিন্তাবিদ জন লক এই মত ব্যক্ত করেন যে,
প্রাক্রাষ্ট্রনৈতিক অবস্থায় প্রাকৃতিক নিয়মের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত জীবনে জনগণ কিছু অধিকার ভােগ করত। জীবন,
সম্পত্তি ও স্বাধীনতার এইসব অধিকারকে লক প্রাকৃতিক অধিকার বা
Natural Rights বলে আখ্যায়িত করেন। তাঁর মতে,
জনগণ এই সমস্ত অধিকার সুষ্ঠুভাবে ভােগ করতে পারত না বলে চুক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্রের সৃষ্টি করে। লকের মতে,
দুটি চুক্তি সম্পাদিত হয়েছিল। প্রথমটি,
জনগণের নিজেদের মধ্যে এবং দ্বিতীয়টি,
রাজার সঙ্গে জনগণের শাসক যতক্ষণ পর্যন্ত চুক্তির শর্ত,
পালন করবেন ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি শাসনক্ষমতা ভােগ করার অধিকার পাবেন। চুক্তির শর্ত পালনে ব্যর্থ হলে জনগণ শাসককে ক্ষমতাচ্যুত করতে পারবে।
টমাস
হবসের
মতবাদ:
১৬৫১
সালে
ইংরেজ
দার্শনিক
টমাস
হবস তাঁর লেভিয়াথান (Leviathan) গ্রন্থে এই অভিমত ব্যক্ত করেন
যে, প্রাকৃতিক অবস্থায় মানুষের জীবন ছিল নিঃসঙ্গ,
দরিদ্র,
ঘৃণ্য,
পাশবিক
ও ক্ষণস্থায়ী। এই অরাজক অবস্থা
থেকে
মুক্তি
পাওয়ার
জন্য
আদিম
মানুষ
নিজেদের
মধ্যে
চুক্তি
করে সমস্ত ক্ষমতা নিঃশর্তভাবে কোনাে
একজন
ব্যক্তি
বা কয়েকজন ব্যক্তির হাতে অর্পণ করে।
হবসের
মতে, পূর্ণ ক্ষমতাপ্রাপ্ত এই ব্যক্তি বা ব্যক্তিসংসদ হলেন
সার্বভৌম
শক্তির
আধার।
সার্বভৌম
কর্তৃপক্ষ হল জনগণের স্বাধীনতার সৃষ্টিকর্তা ও সংরক্ষক। এই কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে
বিদ্রোহ
করার
কোনাে
অধিকার
জনগণের
নেই।
[3] সমালােচনা: রাষ্ট্রের উৎপত্তির
পটভূমি
পর্যালােচনায় সামাজিক
মতবাদের
মৌলিক
অবদান
থাকা
সত্ত্বেও
মতবাদটি
নানা
কারণে
লােচিত
হয়েছে,
যেমন-
·
·
স্ববিরােধী: সমালােচকদের মতে,
আইন ছাড়া কোনো ধরনের অধিকার বা স্বাধীনতার কথা কল্পনা করা যায় না। আদিম সমাজে আইনের কোনাে অস্তিত্ব ছিল না অথচ সেখানে অধিকার ও স্বাধীনতা ছিল,
এ ধরনের বক্তব্য মেনে নেওয়া যায় না।
·
যুক্তিহীন: সমালােচকদের মতে,
রাষ্ট্রীয় আইন হল সামাজিক চুক্তির ভিত্তি। রাষ্ট্রীয় আইন ছাড়া কোনাে চুক্তি সম্পাদন বৈধ হতে পারে না। প্রকৃতির রাজ্যে প্রাক্ৰাষ্ট্ৰীয় অবস্থায় এই ধরনের চুক্তি সম্পাদনের তত্ত্ব তাই আদৌ যুক্তিসংগত নয়।
অনৈতিহাসিক: সামাজিক
চুক্তি
মতবাদের
বিরুদ্ধে
মুখ্য
অভিযােগ
হল চুক্তির দ্বারা রাষ্ট্রের সৃষ্টি
হয়েছে,
এই ধারণা সম্পূর্ণ অনৈতিহাসিক।।
·
ইতিহাসের বিকৃত ব্যাখ্যা প্রদানকারী:
সামাজিক চুক্তি মতবাদ অনুযায়ী প্রাক রাষ্ট্রীয় অবস্থায় ব্যক্তি চুক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্রের সৃষ্টি করেছিল—এই দৃষ্টিভঙ্গি ইতিহাসকে বিকৃত করেছে। অধ্যাপক গেটেলের মতে,
আদিম অবস্থায় সমাজের একক হিসেবে ব্যক্তির কোনাে স্থান ছিল না,
সমাজের একক ছিল পরিবার।
·
অন্যান্য উপাদানের উপেক্ষা:
সামাজিক চুক্তি মতবাদ রাষ্ট্রের ভিত্তি হিসেবে চুক্তির ওপর গুরুত্ব দিয়ে রাষ্ট্র সৃষ্টির অন্যান্য উপাদানকে উপেক্ষা করেছে। রাষ্ট্রের উপাদান হিসেবে বলপ্রয়োগ,
ধর্ম, রক্তের সম্পর্ক ইত্যাদির কোনাে গুরুত্ব এখানে স্বীকার করা হয়নি।
উপসংহার: উপরিউক্ত বিচ্যুতিগুলি সত্ত্বেও সামাজিক চুক্তি মতবাদের তাৎপর্যকে কোনােভাবেই অস্বীকার
করা যায় না। বার্কারের মতে, সামাজিক চুক্তি মতবাদ 'ন্যায়'
ও 'স্বাধীনতা'-র মহান গণতান্ত্রিক আদর্শ
প্রচার
করে গণতান্ত্রিক মূল্যবােধকে সুদৃঢ় করেছে।
No comments:
Post a Comment