Tuesday, August 31, 2021

আধুনিক রাষ্ট্রে স্বাধীনতার রক্ষাকবচগুলি ব্যাখ্যা করো।

 10. 

স্বাধীনতার রক্ষাকবচ

অধ্যাপক ল‍্যাস্কির মতে, স্বাধীনতা বলতে এমন এক পরিবেশের সযত্নে সংরক্ষণকে বোঝায় যে পরিবেশে মানুষ তার ব্যক্তিসত্তাকে পরিপূর্ণ ভাবে বিকশিত করতে পারে। রাষ্ট্র আইনের মাধ্যমে এই পরিবেশকে সংরক্ষণ করে। সমাজবদ্ধ মানুষের জীবনে স্বাধীনতা বলতে কখনো অবাধ বা অনিয়ন্ত্রিত স্বাধীনতাকে বোঝায় না। রাষ্ট্র মানুষের অবাধ স্বাধীনতা কে আইনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রন করে সমাজকল্যাণের উপযোগী হিসেবে গড়ে তোলে। আইন হলো স্বাধীনতার প্রথম রক্ষাকবচ। একজনের স্বাধীনতা ভোগ অন্যজনের সহযোগিতার ওপর নির্ভরশীল। তাই ব্যক্তিস্বাধীনতার যথাযথ সংরক্ষণে আইন অর্থাৎ স্বাধীনতার রক্ষাকবচ অবশ্য প্রয়োজন। লাস্কির অভিমত হলো, সমাজের সকলের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হলে স্বাধীনতার রক্ষাকবচ প্রয়োজন। আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে স্বাধীনতা সংরক্ষণের বিভিন্ন রক্ষাকবচের ব্যবস্থা করা হয়। এরকম রক্ষাকবচগুলি হল নিম্নরূপ-

1) সংবিধানে লিপিবদ্ধ মৌলিক অধিকার:-সংবিধানে লিপিবদ্ধ মৌলিক অধিকারগুলিকে স্বাধীনতার প্রধান রক্ষাকবচ বলে গণ্য করা হয়। সংবিধানের সুস্পষ্ট ভাবে মৌলিক অধিকার লিপিবদ্ধ থাকলে জনগণ সেগুলি সম্বন্ধে অবহিত হওয়ার সুযোগ পায়। সরকার যদি মৌলিক অধিকার লংঘন করে তাহলে জনগণ সাংবিধানিক পদ্ধতিতে নিজেদের অধিকার রক্ষার জন্য আদালতের শরণাপন্ন হতে পারে।

2)ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ:- মন্তেস্কু, ম্যাডিসন, ব্ল্যাকস্টোন প্রমুখ ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণকে স্বাধীনতার অন্যতম রক্ষাকবচ হিসেবে অভিহিত করেছেন। তাদের মতে, সরকারের সমস্ত ক্ষমতা একই ব্যক্তির বা বিভাগের হাতে ন্যস্ত হলে স্বৈরাচারের সম্ভাবনা দেখা দেয়। এর ফলে ব্যক্তি স্বাধীনতাকে ক্ষুন্ন হয়। সেজন্য রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার স্বতন্ত্রীকরন প্রয়োজন। ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ এর ফলে সরকারের কোন বিভাগই ক্ষমতার যথেচ্ছ ব্যবহার করতে পারে না, ফলে ব্যক্তি স্বাধীনতাকে অক্ষুন্ন থাকে।

3)আইনের অনুশাসন:-অধ্যাপক ডাইসি আইনের অনুশাসন বা rule of law কে স্বাধীনতার একটি গুরুত্বপূর্ণ রক্ষাকবচ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। ডাইসির মতে, আইনের অনুশাসন হলো-

১। সাধারণ আইনের সর্বাত্মক প্রাধান্য,

২। আইনের চোখে সমতার নীতি অনুসরণ,

৩। সাধারণ আইন দ্বারা নাগরিক অধিকার গুলি সংরক্ষণ।

এই তিনটি অনুশাসনের ফলে সরকারের স্বৈরাচারী হয়ে ওঠার সুযোগ থাকে না ফলে ব্যাক্তিস্বাধীনতার অক্ষুন্ন থাকে। তা ছাড়া সবার জন্য একই আইনের অস্তিত্ব থাকায় প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সাধারণ নাগরিক পর্যন্ত কেউই বাড়তি সুযোগ সুবিধা ভোগ করতে পারে না।

4)দায়িত্বশীল শাসনব্যবস্থা:-  দায়িত্বশীল শাসন ব্যবস্থা হল স্বাধীনতার একটি রক্ষাকবচ। দায়িত্বশীল শাসন ব্যবস্থায় সরকার আইনসভার জনগণের প্রতিনিধিদের কাছে দায়বদ্ধ থাকে। ত ছাড়া, আইন সবার ভিতর ও বাইরে বিরোধীপক্ষের সমালোচনার ভয়ে সরকার জনগণের স্বাধীনতার পরিপন্থী কোনো কাজ করতে সাহস পায় না। কারণ সুসংবদ্ধ বিরোধী দল জনমতকে সজাগ রাখতে সাহায্য করে।

5) প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক পদ্ধতি:-গণভোট, গণ-উদ্যোগ, পদচ‍্যুতি প্রকৃতি প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক পদ্ধতিকে স্বাধীনতার অন্যতম রক্ষাকবচ বলে গণ্য করা হয়। সরকার নাগরিক স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করলে জনগণ প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক পদ্ধতি প্রয়োগ করে সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এমনকি সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করা সম্ভব হয়। অবশ্য বৃহদায়তন জনবহুল দেশ গুলিতে এইসব পদ্ধতি অনুসরণ করা অসম্ভব। এখানে উল্লেখ করা যায় যে, সুইজারল্যান্ডের মত ক্ষুদ্র রাষ্ট্রে প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক পদ্ধতিগুলি বর্তমান আংশিক রূপে চালু রয়েছে।

6) ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ:-ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ স্বাধীনতার রক্ষাকবচ হিসেবে স্বীকৃত। বলা হয় যে, প্রশাসনিক ক্ষমতা অতিমাত্রায় কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়লে শাসন বিভাগের স্বৈরাচারী হওয়ার প্রবণতা দেখা দেয়, যার ফলে ব্যক্তি স্বাধীনতা ক্ষুন্ন হয়। অধ্যাপক লাস্কির মতে, যে রাষ্ট্রে কেন্দ্রের হাতে অতিমাত্রায় ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত সেখানে স্বাধীনতা থাকতে পারে না।

7) সদাজাগ্রত জনমত:-স্বাধীনতার সর্বশেষ্ঠ রক্ষাকবচ হিসেবে সদা জাগ্রত জনতার কথা উল্লেখ করা হয়। স্বাধীনতার জন্য নাগরিকদের অদম্য আকাঙ্ক্ষা এবং সবরকম ত্যাগ স্বীকারের ইচ্ছা ছাড়া স্বাধীনতা রক্ষা করা যায় না। স্বাধীনতার উপর যে কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ এর বিরুদ্ধে নাগরিকদের সর্বদা সচেতন থাকা প্রয়োজন। গ্রিক দার্শনিক পেরিক্লিস বলেছিলেন যে, চিরন্তন সর্তকতা হলো স্বাধীনতার মূল্য এবং সাহসিকতা হলো স্বাধীনতার মূল মন্ত্র।

8) স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচার ব্যবস্থা:-স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচার বিভাগের অস্তিত্ব ব্যক্তি স্বাধীনতা রক্ষার এক গুরুত্বপূর্ণ রক্ষাকবচ। বিচার বিভাগে স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে তার ভূমিকা পালন করতে পারলে নাগরিকদের অধিকার সুরক্ষিত করা সম্ভব হয়। নিরপেক্ষ বিচার বিভাগ ন্যায়বিচার কে সুনিশ্চিত করে। এর ফলে ব্যাক্তিস্বাধীনতা অক্ষুন্ন থাকে। 

উপসংহার:-স্বাধীনতা কখনো খন্ডিত ভাবে উপলব্ধি করা যায় না। সমাজের কোন অংশে স্বাধীনতা অস্বিকার করে প্রকৃত স্বাধীনতার পরিবেশ গড়ে তোলা যায় না। তাই নিছক আনুষ্ঠানিক পদ্ধতির মাধ্যমে স্বাধীনতার সংরক্ষণ সম্ভব নয়। এ জন্য জনগণকে সদা সচেষ্ট থাকতে হয়।

No comments: