9.
আইন ও স্বাধীনতার সম্পর্ক
স্বাধীনতা ও আয়না সম্পর্ক নিয়ে রাষ্ট্র বিজ্ঞানীদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। অনেকে মনে করেন আইন ছাড়া স্বাধীনতার কথা ভাবা যায় না। আবার অনেকে মনে করেন, আইন এবং স্বাধীনতা দুটি পরস্পরবিরোধী ধারণা মাত্র। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী ও নৈরাজ্যবাদী দার্শনিকরা ব্যক্তি স্বাধীনতা সংরক্ষণে আইন এবং রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের ভূমিকা কে স্বীকার করেননি। অবশ্য বারকার এর মতে, স্বাধীনতার পরিবেশ রাষ্ট্রীয় প্রচেষ্টা ছাড়া গড়ে ওঠে না। নাগরিকরা যে স্বাধীনতা ভোগ করে রাষ্ট্র তা আইনের মাধ্যমে কার্যকর করে। অবশ্য রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের নেতিবাচক ভূমিকার কথাও জন স্টুয়ার্ট মিল, স্পেনসার, ব্রাইস প্রমুখ উল্লেখ করেছেন। ব্রাইস এর মতে, আইন এবং স্বাধীনতার মধ্যে যেকোনো একটিকে প্রাধান্য দিলে অন্যটি সংকুচিত হবে। অবশ্য অবাধ স্বাধীনতা স্বেচ্ছাচারিতার নামান্তর বলে মনে করা হয়। বার্কারের বক্তব্য হল, স্বাধীনতার উৎস হলো আইন। তাই স্বাধীনতা কখনো চূড়ান্ত বা নিঃশর্ত হতে পারে না। কাজেই আইন কখনো স্বাধীনতাকে খর্ব করে না বরং স্বাধীনতার বিকাশ ঘটাতে সাহায্য করে। হব হাউস এর মতে, আইন না থাকলে ক্ষমতাবান মুষ্টিমেয় ব্যক্তি স্বাধীনতা ভোগের অধিকারী হবে, অন্যরা বঞ্চিত হবে।
1) আইন ব্যক্তি স্বাধীনতার রক্ষাকবচ:-আইনের সাহায্যে রাষ্ট্র নানাভাবে ব্যক্তি স্বাধীনতাকে সংরক্ষণ করে। যেমন-
১। আইন আছে বলেই সকলের হাতে দুর্বলের রক্ষা পায়।
২। আইনের মাধ্যমে সংরক্ষিত থাকে বলে নাগরিক স্বাধীনতা খুব সহজে কোন শাসক গোষ্ঠী কেড়ে নিতে পারে না।
৩। আইনজী শুধুমাত্র স্বাধীনতাকে সংরক্ষণ করে তাই না, স্বাধীনতার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ গঠনেও আইন সাহায্য করে। নাগরিকদের অন্তর্নিহিত সত্তার সর্বাঙ্গীণ বিকাশের নাম স্বাধীনতা। আইনের দ্বারাই স্বাধীনতার প্রকাশ ঘটে।
2)আইনের প্রতি আনুগত্য প্রকাশই স্বাধীনতা:- আধুনিক জনকল্যাণকর রাষ্ট্র নাগরিকদের ব্যক্তিত্ব বিকাশের জন্য আইনের মাধ্যমে উপযুক্ত শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান, শান্তিপূর্ণ সামাজিক পরিবেশের সুরক্ষা ইত্যাদির ব্যবস্থা করে থাকে। নাগরিকদের আত্মবিকাশের উপযোগী সুযোগ-সুবিধাকে যদি স্বাধীনতা বলা হয়, তাহলে তা অবশ্যই আইনের মাধ্যমে সৃষ্টি হয়। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনপ্রতিনিধিরা আইন সভায় আইন প্রণয়নের কাজ সম্পাদন করে। তাই আইনের প্রতি জনগণের স্বাভাবিক অনুগত থাকে। এই কারণে রুশো আইনের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ কে স্বাধীনতা বলেছেন।
3)আইন ও স্বাধীনতার পরস্পরের পরিপূরক:-সমাজবিজ্ঞানী বার্কার স্বাধীনতাকে আপেক্ষিক বলে বর্ণনা করেছেন। একজনের স্বাধীনতা অন্যজনের স্বাধীনতা ভোগের প্রশ্নের সঙ্গে জড়িত। কাজই নিয়ন্ত্রণ ছাড়া স্বাধীনতার কোনো অর্থ হয় না। লাস্কির মতে, স্বাধীনতার প্রকৃতির মধ্যেই নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। সমাজের প্রতিটি নাগরিকের স্বাধীনতা সংরক্ষণের দায়িত্ব রাষ্ট্রের। আইনের মাধ্যমে রাষ্ট্র এই দায়িত্ব পালন করে থাকে। আইন ও স্বাধীনতা পরস্পর বিরোধী নয়, বরং একে অপরের পরিপূরক। এই কারণে বলা হয়, স্বাধীনতার শর্ত হলো আইন। 4)সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আইন স্বাধীনতার প্রকৃত শর্ত:-মার্কসবাদীরা মনে করেন, ধনবৈষম্যমূলক সমাজে রাষ্ট্রীয় আইনের প্রকৃতি বৈষম্যমূলক। রাষ্ট্র এখানে সকল জনগণের বদলে অল্প কিছু বিত্তবান শ্রেণীর স্বার্থ ও স্বাধীনতাকে সংরক্ষণ করে। একমাত্র সমাজতান্ত্রিক সমাজের আইনের মাধ্যমে জনগণের স্বাধীনতা সংগ্রাম সম্ভব। আইন সেখানে স্বাধীনতার প্রকৃত শর্ত রূপে কাজ করে।
উপসংহার:-আইন ও স্বাধীনতার সম্পর্ক কখনোই বিচ্ছিন্ন নয়, একে অপরের পরিপূরক।
No comments:
Post a Comment