4.
তৃতীয় বিশ্বের জাতীয়তাবাদ
তৃতীয় বিশ্ব নামটি প্রথম ব্যবহৃত হয়েছিল ১৯৫২ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশগুলিকে এক সঙ্গে তৃতীয় বিশ্ব আখ্যা দেওয়া হয়েছিল। প্রথম বিশ্ব অর্থাৎ উন্নত ধনতান্ত্রিক দেশগুলি এবং দ্বিতীয় বিশ্ব, অর্থাৎ সমাজতান্ত্রিক দেশগুলি থেকে এদের পৃথক করার জন্যই এই নামকরণ করা হয়। রাজনৈতিক ধারণা হিসেবে ইউরোপের জাতীয়তাবাদ ও তৃতীয় বিশ্বের জাতীয়তাবাদের মধ্যে মৌলিক কোনাে পার্থক্য নাই। তবে তৃতীয় বিশ্বের জাতীয়তাবাদের কতকগুলি বৈশিষ্ট্য আছে। যথা-
[1] সাম্রাজ্যবাদ বিরােধী:- ইউরোপে জাতীয়তাবাদের প্রসার ঘটেছিল নবজাগরণের মাধ্যমে এবং জাতি রাষ্ট্র গঠনের মাধ্যমে তা পরিপূর্ণতা লাভ করে। কিন্তু তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটেছিল সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। এইজন্য তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে জাতি রাষ্ট্র গঠনে জাতীয়তাবাদ ব্যর্থ হয়েছে।
[2] ধর্মীয় প্রভাব:- যেহেতু তৃতীয় বিশ্বের দেশ গুলি দীর্ঘদিন ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে ছিল তাই ওই সমস্ত দেশ গুলির মধ্যে মধ্যযুগীয় ধ্যান-ধারণা অক্ষুন্ন রয়ে গেছিল এর একটা বড় লক্ষণ হলো জাতীয় জীবনে ধর্মের প্রভাব এইজন্য তৃতীয় বিশ্বের জাতীয়তাবাদী ধারণা ধর্মীয় প্রভাব মুক্ত হতে পারেনি ফলে জাতীয়তাবাদ তার ঐক্যবদ্ধ রূপ প্রকাশ করতে অসমর্থ।
[3] গােষ্ঠীগত ভেদাভেদ:- বিভিন্ন গোষ্ঠী তার গোষ্ঠীর প্রভাব প্রশান্তের মনোভাব করতে না পারার ফলে বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে ঐক্যবদ্ধ চেতনার বহিঃপ্রকাশ কাটেনি বলে এক সামগ্রিক জাতীয়তাবাদের পরিবর্তে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে আঞ্চলিক জাতীয়তাবাদ প্রশ্রয় পায়।
[4] ভাষাগত বিভেদ:-তৃতীয় বিশ্বের দেশ গুলি দীর্ঘদিন ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে ছিল তাই শাসক তা নিজের ভাষায় শিক্ষিত একশ্রেণীর মানুষের মাধ্যমে আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করে। শাসকের ভাষায় শিক্ষিত সম্প্রদায় মাধ্যমে ভাষাগত বিভেদ সৃষ্টি করে শাসক সম্প্রদায় তৃতীয় বিশ্বের জাতীয়তাবাদকে দুর্বল করে।
[5] জাতিগত বিভেদ:-তৃতীয় বিশ্বের দেশ গুলি বহুদিন ঔপনিবেশিক শাসনে থাকায় শাসক সম্প্রদায় জাতিতে জাতিতে ভেদাভেদ সৃষ্টির মাধ্যমে ওইসব দেশে জাতীয়তাবাদকে দুর্বল করে তোলে। কারণ, শাসক সম্প্রদায়ের নীতি ছিল ভাগ কর ও শাসন কর।
[6] আবেগ প্রবণ:- ঔপনিবেশিক শাসনের বিরোধিতা করতে গিয়ে ওই সব দেশের জাতীয়তাবাদ অতিরিক্ত আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে। এই আবেগপ্রবণতা অনেক সময়ই যুক্তি দ্বারা পরিচালিত হতো না। যে জন্য আদর্শগত কারণে তৃতীয় বিশ্বের দেশ গুলির জাতীয়তাবাদ কখনো কখনো শক্তিশালী হলেও তা প্রায়ই দিশাহীন ও অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ত।
[7] শিক্ষার অভাব:-অশিক্ষা ও অনগ্রসরতার জন্য ওইসব দেশে সামন্ততান্ত্রিক প্রভাব পরিলক্ষিত হয় ফলে মুষ্ঠিমেয় লোক গণতন্ত্রের প্রতি আকৃষ্ট হলেও আধিপত্যমূলক মনোভাবের জন্য আজব গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো ও গণতান্ত্রিক চেতনা সম্পূর্ণরূপে বিকশিত হয়নি।
[8] নির্দিষ্ট লক্ষ্যের অভাব:-ইউরোপে জাতীয়তাবাদের লক্ষ্য ছিল বুর্জোয়া জাতি রাষ্ট্র গঠন কিন্তু তৃতীয় বিশ্বের দেশ গুলি ওরকম কোন নির্দিষ্ট লক্ষ্যের দ্বারা পরিচালিত হয়নি তাই স্বাধীনতা লাভের পরেও কোন কোন দেশে আধা-সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা বা কোথাও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কোথাও সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা গড়ে ওঠে।
মূল্যায়ন:- তৃতীয় বিশ্বের দেশ গুলির জাতীয়তাবাদ ইউরোপে জাতীয়তাবাদ থেকে পৃথক হলেও তৃতীয় বিশ্বের জাতীয়তাবাদ ওইসব দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে উদ্বুদ্ধ করেছিল যে কারণে জাতীয়তাবাদের উদ্ভব সেই জাতীয়তাবাদী তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো বিকাশে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে চলেছ।
No comments:
Post a Comment