Tuesday, August 31, 2021

সাম্যের সংজ্ঞা প্রকৃতি ও ধরন বিশ্লেষণ করো।

 11. 

সাম্যের সংজ্ঞা

সাধারণভাবে সাম্য বলতে সব মানুষের সমতাকে বোঝায়। কিন্তু, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সাম্য বা equality কথাটির কোন অর্থে ব্যবহৃত হয় যেখানে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সাম্য বলতে বোঝায় সব মানুষের ব্যক্তিত্ব বিকাশের উপযোগী যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা সমতা।

 সাম্যের প্রকৃতি

অধ্যাপক হ্যারল্ড লাস্কি সাম্যের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে তার দুটি মূল বৈশিষ্ট্যের কথা তুলে ধরেন-

১। সাম্য হল বিশেষ সুযোগ সুবিধার অনুপস্থিতি,

২। সাম্য বলতে সকলের জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা সুনিশ্চিত করা কে বোঝায়

এছাড়াও মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গীতে সাম্যের প্রকৃতির কথা উল্লেখ করা যেতে পারে।

 1) বিশেষ সুযোগ সুবিধার অনুপস্থিতি:-বস্তুত দৈহিক, মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তি গত শক্তি-সামর্থের বিচারে সব মানুষ কখনো সমান হতে পারে না। মানুষের মধ্যে প্রকৃতিগত বৈষম্য রয়েছে। সব মানুষের ক্ষমতা, চাহিদা ও প্রয়োজন একই রকমের নয়। লাস্কির মতে, রাষ্ট্র যদি একজন গণিতজ্ঞ রাজমিস্ত্রিকে একই মূল্যে দেয় তাহলে তার প্রতিভার বিকাশ ঘটবে না। এর ফলে সমাজের অগ্রগতি ব্যাহত হবে। কাজী সাম্য বলতে কখনোই সমস্ত মানুষের জন্য একই ব্যবস্থা বুঝায় না। 

2)সকলের জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা সুনিশ্চিতকরণ:-লাস্কির মতে, সাম্য বলতে বোঝায় সব মানুষের ব্যক্তিত্বের পূর্ণ বিকাশের উপযোগী পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা ব্যবস্থা। বস্তুত, সমস্ত নাগরিককে সমান সুযোগ-সুবিধা দিলে সবাই যে সেই সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করে সমানভাবে ব্যক্তিত্বের উন্নতি ঘটাতে পারবে তা কিন্তু নয়। রাষ্ট্র শুধুমাত্র সকলের জন্য সমান সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা গড়ে তুলবে যাতে প্রত্যেকে তার ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটাতে পারে।

3) মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গীতে সাম্য:-মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে, ধনবৈষম্যমুলক ও শ্রেণীবিভক্ত সমাজে প্রকৃত সাম্যের অস্তিত্ব কখনোই সম্ভব নয়। ব্যক্তিগত সম্পত্তির বিলোপ না ঘটলে সাম্য প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। লেনিনের মতে, একশ্রেণীর দ্বারা অন্য শ্রেণীকে শোষণের সমস্ত রকম সম্ভাবনা যতক্ষণ না পর্যন্ত বিনষ্ট হচ্ছে ততক্ষণ কোন প্রকৃত বা বিশুদ্ধ সাম্য প্রতিষ্ঠা হবে না।

সাম্যের ধরন বা প্রকারভেদ

1) স্বাভাবিক সাম্য:- স্বাভাবিক সাম্যের তত্ত্ব অনুসারে, মানুষ জন্ম থেকেই স্বাধীন। প্রতিটি মানুষ সমানাধিকার সম্পন্ন। ফরাসি দার্শনিক রুশো বলতেন, মানুষ স্বাধীন হয়ে জন্মায়, কিন্তু সর্বত্র সে শৃংখলে আবদ্ধ। প্রাচীন গ্রিসে স্টোয়িক দার্শনিকরা এবং রোমান চিন্তাবিদ সিসেরো ও পলিবিয়াস প্রমুখ স্বাভাবিক সাম্যের ধারণা প্রচার করেছিলেন।

2)সামাজিক সাম্য:-সামাজিক সাম্য সাধারণত জাতি-ধর্ম-বর্ণ বংশমর্যাদা স্ত্রী-পুরুষ ধনী-নির্ধন নির্বিশেষে সব রকমের মানুষের সামাজিক ক্ষেত্রের পদমর্যাদা। রাষ্ট্র বিজ্ঞানীদের মতে, দাস সমাজ ও সামন্ত সমাজে সামাজিক সাম্যের অস্তিত্ব ছিলনা। পরবর্তীকালে আইনের অনুশাসনের প্রসার লাভর ফলে সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়।

3)রাজনৈতিক সাম্য:-রাজনৈতিক অধিকারের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ভোট দেয়ার অধিকার, ভোটে দাঁড়ানোর অধিকার, রাজনীতিতে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণের অধিকার প্রভৃতি। রাজনৈতিক সাম্য গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মূলভিত্তি।

4)আইনগত সাম্য:-আইনের দৃষ্টিতে সমতা ও আইন কর্তৃক সমভাবে সংরক্ষিত হওয়ার অধিকারকে আইনগত সাম্য বলে অভিহিত করা হয়। আইনের দৃষ্টিতে সমতা অর্থ হল সব নাগরিক আইনের চোখে সমান। অন্যদিকে আইন কর্তৃক সমভাবে সংরক্ষিত হওয়ার অধিকার এর অর্থ হল আইনের মাধ্যমে সব নাগরিককে সমান সুরক্ষা প্রদানের ব্যবস্থা করা।

5) অর্থনৈতিক সাম্য:-অর্থনৈতিক সাম্য হল নাগরিকের আর্থিক সুযোগ-সুবিধা ভোগের সমতা। মার্কসীয় দর্শনে অর্থনৈতিক সাম্যকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। লাস্কির মতে, অর্থনৈতিক সাম্য ছাড়া রাজনৈতিক সাম্যের কোন মূল্য নেই। অর্থনৈতিক অসাম্যের কারণে রাজনৈতিক ক্ষমতা সম্পত্তিবাণ শ্রেণীর হাতে থাকার সম্ভাবনা থাকে। 

6)আন্তর্জাতিক সাম্য:-আন্তর্জাতিক সাম্য প্রতিটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের সমমর্যাদার ধারণাকে বোঝায়। আন্তর্জাতিক সাম্যের মূল বক্তব্য হলো ক্ষুদ্র বৃহৎ নির্বিশেষে সমস্ত জাতীয় রাষ্ট্রের মর্যাদা ও গুরুত্ব সমান। প্রসঙ্গত বলা যায়, সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের সনদের 2 (১) নং ধারায় সব সদস্যরাষ্ট্রের সমান সার্বভৌমত্বের নীতিকে স্বীকৃতি জানানো হয়েছে।

No comments: