5,
আন্তর্জাতিকতাবাদের অর্থ
বৃহত্তর বিশ্বসমাজ গঠনের উদ্দেশ্যে নিবেদিত এক আদর্শের নাম হল আন্তর্জাতিকতাবাদ। বিশ্বমানবতা,
বিশ্বশান্তি এবং বিশ্বভ্রাতৃত্বের নীতি হল আন্তর্জাতিকতার প্রধান উপাদান। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী গােল্ডস্মিথের অভিমত অনুসারে,
আন্তর্জাতিকতাবাদ হল এমন একটি ধারণা যা একজন ব্যক্তিকে শুধুমাত্র তার নিজের দেশের নয়,
সমগ্র পৃথিবীর নাগরিক হিসেবে গণ্য করে।
উদ্দেশ্য:- আন্তর্জাতিকতা, বিভিন্ন জাতির মধ্যে স্বাতন্ত্র পথের বিসর্জন না দিয়ে তাদের মধ্যে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক সহযোগিতার বন্ধনকে দৃঢ় করে, স্বাধীনতা, সাম্য ও সৌভ্রাতৃত্বের ভিত্তিতে এক বিশ্বসমাজ গড়ে তুলতে চায়।
বিকাশ:- বিগত শতাব্দীতে পরপর দুটি বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বের মনীষীদের চিন্তায় জাতীয় রাষ্ট্র তথা জাতীয়তাবাদের বিকল্প হিসেবে বিশ্বরাষ্র তথা আন্তর্জাতিকতাবাদের ধারণাটি প্রাধান্য পায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় উগ্র জাতীয়তাবাদ যেভাবে মানবজাতিকে এক সর্বাত্মক ধ্বংসের পথে ঠেলে দেয়,
তা থেকে মুক্তির পথ হিসেবে আন্তর্জাতিকতাবাদের জন্ম হয়।
আন্তর্জাতিকতাবাদের বৈশিষ্ট্য
আন্তর্জাতিকতাবাদের কয়েকটি উল্লেখযােগ্য বৈশিষ্ট্য হল-
[1] বিশ্বশান্তি ও মানবসভ্যতার সংরক্ষক:- আন্তর্জাতিকতা বিশ্বশান্তি ও মানব সভ্যতাকে সযত্নে রক্ষা করে। বর্তমান বিশ্বে আণবিক যুদ্ধের আশঙ্কা বেড়ে চলেছে। এমতাবস্থায় আন্তর্জাতিকতার আদর্শ আমাদের যুদ্ধহীন পৃথিবীর স্বপ্ন দেখায়, মানবসভ্যতাকে রক্ষা করে সমৃদ্ধির পথে চালিত করে।
[2] পারস্পরিক রাষ্ট্রীয় সহযােগিতার পৃষ্ঠপােষক:-বর্তমান বিশ্বে কোন রাষ্ট্র বিচ্ছিন্ন ভাবে টিকে থাকতে পারে না। জাতীয় রাষ্ট্রগুলি পারস্পরিক সহযোগিতার বন্ধনে আবদ্ধ হতে বাধ্য হয়েছে। মুক্ত বাণিজ্য নীতি, অবাধ পণ্য চলাচল, আর্থিক সংস্কার, সাংস্কৃতিক বিনিময় ইত্যাদি কারণে রাষ্ট্রগুলি পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল। একমাত্র আন্তর্জাতিকতা পথে পারস্পরিক সহযোগিতার এই ক্ষেত্রটির সম্প্রসারণ ঘটিয়ে এক উন্নততর বিশ্ব ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব।
[3] সাম্রাজ্যবাদবিরোধী:-আন্তর্জাতিকতা, সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ ও নয়া উপনিবেশবাদের বিরোধী। তাই আন্তর্জাতিকতার আদর্শে নতুন বিশ্ব রাষ্ট্র গঠিত হলে ক্ষুদ্র বৃহৎ নির্বিশেষে সমস্ত জাতি রাষ্ট্র সমমর্যাদার অধিকারী হতে পারে। আন্তর্জাতিকতা বিশ্বের সাম্রাজ্যবাদী শক্তি এবং উপনিবেশবাদী ও নয়া উপনিবেশবাদী চক্রান্তের গতিরোধ করতে সক্ষম।
[4] বিশ্বসমৃদ্ধির সহায়ক:-আন্তর্জাতিকতাকে অনেকেই বিশ্বসমৃদ্ধির সহায়ক বলে অভিহিত করেছেন। আন্তর্জাতিকতার আদর্শ গ্রহণ করা হলে পৃথিবীতে যুদ্ধের কোনো প্রয়োজনীয়তা থাকবে না। আর যুদ্ধের প্রয়োজন ফুরোলেই সামরিক ব্যয় অস্ত্রশস্ত্র নির্মাণ বিশাল সেনাবাহিনী রক্ষণাবেক্ষণ কোনো কিছুরই দরকার হবে না। ফলে বিপুল পরিমাণ অর্থের সাশ্রয় হবে ও বিশ্ববাসী সুখে বসবাস করতে পারবে।
[5] জাতিবৈরিতার অবসানের পক্ষপাতী:-আন্তর্জাতিকতা জাতি বৈরিতার অবসান ঘটিয়ে এক জাতি এক রাষ্ট্র নীতি আদর্শের ভিত্তিতে উন্নত বিশ্ব ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সাহায্য করে। পৃথিবীর বিভিন্ন জাতির মধ্যে বিরোধের অবসান ঘটিয়ে আন্তর্জাতিকতা বিশ্ব ভ্রাতৃত্ববোধের প্রসার ঘটায়।
[6] মানবসভ্যতার বিকাশে সহায়ক:-আন্তর্জাতিকতা আদর্শ মানব জাতি ও মানব সভ্যতার চরম বিকাশ ঘটাতে সাহায্য করে। আন্তর্জাতিকতায় বিশ্বাস করা হয় যে, প্রতিটি জাতির নিজস্ব বৈশিষ্ট্য আছে। আন্তর্জাতিকতাবাদে কোন জাতির জাতীয় সত্তার বিলোপের পক্ষে সওয়াল করা হয় না। বরং আন্তর্জাতিকতার আদর্শে পৃথিবীর বিভিন্ন জাতির জাতীয় সত্তাকে মানব সভ্যতার মূল স্রোতের সঙ্গে যুক্ত করার কথা বলা হয়। আন্তর্জাতিকতায় একথা বিশ্বাস করা হয় যে, সমস্ত জাতির নিজস্ব সত্তা স্বাধীন ভাবে বিকশিত হলে মানব জাতি ও মানব সভ্যতার চরম বিকাশ ঘটা সম্ভব।
[7] সংকীর্ণ বা বিকৃত জাতীয়তাবাদের বিরােধী:-আন্তর্জাতিকতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো সংকীর্ণ বা বিকৃত জাতীয়তাবাদের বিরোধ করা। অনিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় রাষ্ট্রগলির জাতিগত সংকীর্ণতা মানবজাতিকে বারবার যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিয়েছে। এই কারণে আন্তর্জাতিকতায় জাতিগত আধিপত্যেবাদের কোন স্থান নেই।
উপসংহার:-আন্তর্জাতিকতার আদর্শ বর্তমানের সংকীর্ণ রাষ্ট্রীয় স্বার্থের সংঘাতে জর্জর পৃথিবীতে এক প্রাসঙ্গিক আদর্শ। তাই অনেকে মনে করেন আন্তর্জাতিকতার কোন বিকল্প নেই। বিদ্বেষপূর্ণ মানসিকতার বদলে আন্তর্জাতিকতা আদর্শ পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে যে সহযোগিতা ও সৌভাগ্যের পরিবেশ গড়ে তোলে তার ফলে মানবসমাজের সুখ ও সমৃদ্ধি সুনিশ্চিত হতে পারে।
No comments:
Post a Comment