Tuesday, August 31, 2021

জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার বলতে কী বোঝো? জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার এর স্বপক্ষে ও বিপক্ষে যুক্তিগুলি ব্যাখ্যা করো।

 2. 

জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার



[1] সূত্রপাত: ১৭৭২ সালে পােল্যান্ডের বিভক্তিকরণের ঘটনাকে ভিত্তি করেই জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণ-সম্পর্কিত আলোচনার সূত্রপাত ঘটে



[2] অর্থ ব্যাখ্যা: প্রত্যেক জাতির স্বাধীন স্বতন্ত্র রাষ্ট্র গঠন করার অধিকারকে বলা হয় আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার। আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার তত্ত্বের মূলভিত্তি হল এক জাতি, এক রাষ্ট্র নীতি। এই নীতি অনুসারে প্রতিটি রাষ্ট্র হবে জাতিভিত্তিক। এক-একটি জাতিকে নিয়ে গঠিত হবে এক-একটি রাষ্ট্র। কোনাে রাষ্ট্র যদি পাঁচটি জাতিকে নিয়ে গঠিত হয়ে থাকে তাহলে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার নীতি অনুসারে ওই রাষ্ট্রকে ভেঙে পাঁচটি আলাদা আলাদা রাষ্ট্র তৈরি করতে হবে



[3] মিলের মত: এই তত্ত্বের অন্যতম প্রবক্তা জন স্টুয়ার্ট মিলের বক্তব্য হল, জাতীয় জনসমাজের সীমানা রাষ্ট্রের সীমানার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়া বাঞ্ছনীয়



[4] লেনিনের মত: লেনিনের মত, বিদেশি শাসন থেকে মুক্তি স্বাধীন সরকার গঠন বা অত্যাচারী শাসকের হাত থেকে রাজনৈতিক মুক্তি হল আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার



জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের পক্ষে বিপক্ষে যুক্তি



জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের পক্ষে যুক্তিগুলি হল— 

 [1] সংখ্যালঘু সমস্যার সমাধানে সহায়ক:-মার্কিন রাষ্ট্রপতি উইলসন এর মতে, প্রতিটি জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার বিশ্বজনীন ভাবে মেনে নেয়া প্রয়োজন। কারণ এর ফলে সংখ্যালঘু সমস্যার সমাধান হবে ও তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব, বৈরীভাব প্রভৃতি শেষ হয়ে পৃথিবী থেকে যুদ্ধের ভয় দূর হবে।

 [2] গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার পক্ষে উপযুক্ত:- জন স্টুয়ার্ট মিল বলেন, বহু জাতিভিত্তিক রাষ্ট্রে জনগণের মধ্যে পারস্পরিক সদ্ভাব ও সম্প্রীতি থাকে না। তাই গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা সাফল্যের জন্য মিল এক জাতিভিত্তিক আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার কে স্বীকার করে নেয়ার পক্ষে যুক্তি দেখান।

 [3] জাতীয় গুণাবলির বিকাশে সহায়ক:- আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার এর নীতির প্রবক্তাদের মতে, প্রতিটি জাতির কিছু মৌলিক গুণাবলী রয়েছে, যেগুলি পূর্ণাঙ্গ বিকাশ শুধুমাত্র এক জাতিভিত্তিক রাষ্ট্রীয় সরকারের মাধ্যমে ঘটা সম্ভব।

 [4] বিশ্বসভ্যতার বিকাশে সহায়ক:- প্রতিটি জাতির নিজস্ব রাষ্ট্র ও সরকার থাকলে সেই জাতির সভ্যতা ও সংস্কৃতি দ্রুত বিকশিত হয়। এইভাবে বিশ্বব্যাপী সভ্যতার বিকাশের বিভিন্ন জাতির মধ্যে সুস্থ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে বিশ্ব সংস্কৃতির সমৃদ্ধি ও অগ্রগতি সম্ভব হয়।

 [5] নৈতিক মানদণ্ডে সমর্থনযােগ্য:- নৈতিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে বলা হয় যে, প্রতিটি জাতির স্বাধীনভাবে নিজে নিজে ভাগ্য নির্ধারণ করার অধিকার থাকা বাঞ্ছনীয়। এই ন্যায় সঙ্গত দাবীর অর্জিত হলে দুর্বলের উপর সবলের অত্যাচার বন্ধ হবে।

 [6] জাতিগত সংঘাতের সম্ভাবনা হ্রাস:- আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার স্বীকৃত হলে কিংবা এক জাতি এক রাষ্ট্র নীতি অনুসারে রাষ্ট্র গঠিত হলে জাতিগত সংঘাত বা বিরোধের আশঙ্কা দূর হবে। বহু জাতি ভিত্তিক রাষ্ট্রে বিভিন্ন জাতীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে যে পারস্পরিক বিদ্বেষ ও জাতিদাঙ্গা দেখা যায় তা এখানে দেখতে পাওয়া সম্ভবনা কম।

[7] রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের সঙ্গে ব্যক্তিস্বাধীনতার সমন্বয়সাধন:- একটি জাতির নিজস্ব সরকার থাকলে রাষ্ট্রীয়  কর্তৃত্বের সঙ্গে ব্যাক্তিস্বাধীনতার সুষ্ঠু সমন্বয় সাধন সম্ভব হয়। তাছাড়া একটি রাষ্ট্রে শুধুমাত্র একটি জাতি থাকলে কোন অভ্যন্তরীণ বিবাদ-বিসংবাদ না থাকায় প্রত্যেকে নিজের দেশকে প্রাণ দিয়ে ভালবাসতে সক্ষম হয়।



বিপক্ষে যুক্তি:

[1] অখণ্ডতার পরিপন্থী:- এক জাতি এক রাষ্ট্র নীতি স্বীকৃত হলে পৃথিবীর বৃহৎ রাষ্ট্রগুলি বহু বিভক্ত হয়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রে পরিণত হবে। এইসব ক্ষুদ্র ও দুর্বল রাষ্ট্র কখনোই আত্মনির্ভরশীল অর্থনীতি গড়ে তুলতে পারবে না বৃহৎ রাষ্ট্রগুলি শিকারে পরিণত হবে।

[2] অবাস্তব:- একই পরিবেশে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষ সুদীর্ঘকাল একত্রে বসবাস করার ফলে তাদের বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব হয় না। জাতিগত বিভেদ এর পরিপ্রেক্ষিতে ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টি হলেও ভারত এবং মুসলমান জনগোষ্ঠীর মানুষ এখনো রয়ে গেছে।

 [3] উন্নত সভ্যতা সংস্কৃতির পরিপন্থী:- ইংরেজ দার্শনিক লর্ড অ্যাক্টন এর বক্তব্য হল, বহু জাতি ভিত্তিক রাষ্ট্র সভ্যতা ও সংস্কৃতির দিক দিয়ে উন্নততর পর্যায়ে যেতে সমর্থ হয়। অন্যদিকে, রাষ্ট্রীয় সীমারেখার ভিতর যেখানে শুধু একটি মাত্র জাতি বসবাস করি সেই সমাজের অন্য অনগ্রসর হয়ে পড়ার সম্ভাবনা থাকে।

 [4] উদ্বাস্তু সমস্যার সৃষ্টিকারী:- বহুজাতিক ভিত্তিক রাষ্ট্রগুলিকে জাতীয়তর ভিত্তিতে বিচ্ছিন্ন করা হলে উদবাস্তু সমস্যার সৃষ্টি হবে। জাতীয়তার ভিত্তিতে ভারত বিভাগের ফলে বহু হিন্দু পরিবার উদবাস্তু হিসাবে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতে চলে আসতে বাধ্য হন, এর ফলে ভারতে তীব্র উদবাস্তু সমস্যা দেখা দেয়।

[5] সংখ্যালঘু সমস্যার সমাধানে সহায়ক নয়:- উইলসনের মতে, জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার তত্ব সংখ্যালঘু সমস্যা সমাধান ও বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় সহায়ক। সমালোচকরা এ যুক্তি মানতে পারেননি। কারণ, এই তত্বের ভিত্তিতে অবিভক্ত ভারত দ্বিখন্ডিত হয়, তা সত্বেও ভারত ও পাকিস্তানে সংখ্যালঘু জাতি সমস্যার সমাধান হয়নি।

 [6] অগণতান্ত্রিক:-"এক জাতি এক রাষ্ট্র" তত্ত্বের সঙ্গে গণতন্ত্রের কোন সম্পর্ক নেই। বহুজাতিভিত্তিক ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সুইজারল্যান্ডের অধিবাসীরা কোন অংশে কম গণতান্ত্রিক অধিকার ভোগ করেন না।

[7] বৈরী মনােভাবের জন্মদাতা:- কার্জনের মতে, জাতির আত্বনিয়ন্ত্রণের অধিকার তত্ত্ব হল এমণ একটি অস্ত্র যার দুদিকেই ধার আছে। একদিকে যেমন এই নীতিটি জাতীকে ঐক‍্যবদ্ধ ও রাজনৈতিক চেতনা সম্পন্ন করতে সাহায্য করে, অন‍্যদিকে তেমনি বিভিন্ন জাতিকে বিচ্ছিন্ন করে তাদের মধ্যে পারস্পরিক ঘৃণা, বিদ্বেষ ও সন্দেহের সৃষ্টি করে বৈরী মনোভাবের জন্ম দেয়।

 [8] ইতিহাসের পশ্চাদ্গতির সূচক:- অ্যাকটনের মতে, আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার ইতিহাসের পশ্চাৎগতির ইঙ্গিত দেয়। এই সভ‍্য যুগে মানুষ ঐক‍্যবদ্ধ হয়ে থাকার বদলে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকতে চাইলে তা মানব সমাজের পশ্চাৎগতির সূচনা করবে।

No comments: