Tuesday, August 31, 2021

আন্তর্জাতিক আইন কাকে বলা হয়? আন্তর্জাতিক আইনের অর্থ প্রকৃতি বিশ্লেষণ করো।

 3. 

আন্তর্জাতিক আইনের সংজ্ঞা

বর্তমান পৃথিবীতে স্বয়ংসম্পূর্ণ আত্মনির্ভরশীল জাতীয় রাষ্ট্রের কথা কল্পনা করা যায় না। আধুনিক জাতীয় রাষ্ট্রগুলি অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে পরস্পর নির্ভরশীল। কিছু নিয়মকনুন এর মাধ্যমে এই পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ধারিত হয়। এই নিয়ম কানুন গুলিকে আন্তর্জাতিক আইন বলে অভিহিত করা হয়।

আন্তর্জাতিক আইনের অর্থ ও প্রকৃতি :-

আন্তর্জাতিক আইনের অর্থ ও প্রকৃতি নির্ধারণের প্রশ্নে রাষ্ট্রবিজ্ঞান এর মধ যথেষ্ট মতবিরোধ রয়েছে। একদিকে অস্টিন, হল্যান্ড প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আন্তর্জাতিক আইন কে আইন পদবাচ্য বলে স্বীকার করেনি। অন্যদিকে, হেনরি মেইন, স‍্যাভিনি প্রমুখ আন্তর্জাতিক আইনকে আইন পদবাচ্য বলে মনে করেন।

🕳️ আইন পদবাচ্য নয়:-

অস্টিন, হল্যান্ড প্রমূখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর মতে, সার্বভৌম কর্তৃপক্ষের সুনির্দিষ্ট আদেশ হল আইন। এই আদেশ অধঃস্তনের উপর প্রযোজ্য হয়। তাছাড়া আইন অমান্যকারীদের শাস্তি দেয়ার ক্ষমতা সার্বভৌম কর্তৃপক্ষের হাতে রয়েছে। আইনের এইসব বৈশিষ্ট্য আন্তর্জাতিক আইনের ক্ষেত্রে দেখা যায় না। আন্তর্জাতিক আইনকে আইন পদবাচ্য মনে না করার পক্ষে কারণ গুলি হল-

!) সার্বভৌম কর্তৃপক্ষের অনস্তিত্ব:-আন্তর্জাতিক আইনের ক্ষেত্রে কোন সার্বভৌমত্বের অস্তিত্ব নেই। আন্তর্জাতিক আইন কোন সার্বভৌম কর্তৃপক্ষের আদেশ বলে বিবেচিত হয় না। এই কারণে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনকারী রাষ্ট্রকে শাস্তি দেয়া যায় না।

!!) সুনির্দিষ্ট উৎসের অভাব:-আন্তর্জাতিক আইন কোন সুনির্দিষ্ট আকারে লিপিবদ্ধ না হয়নি। আন্তর্জাতিক আইনের কোনো সুনির্দিষ্ট ও সুস্পষ্ট উৎস নেই। হল্যান্ডের মতে, আন্তর্জাতিক আইন হলো আইন শাস্ত্রের একটি অদৃশ্য বিন্দু।

!!!) বৈধতা আংশিক ও অসম্পূর্ণ:-অধ্যাপক লাস্কির বক্তব্য অনুসারে আন্তর্জাতিক আইনের বৈধতা আংশিক এবং অসম্পূর্ণ, কারণ বিভিন্ন রাষ্ট্রের সম্মতির উপর আন্তর্জাতিক আইন নির্ভরশীল।

!v) জাতীয় আইনের তুলনায় গুরুত্বহীন:-লর্ড সলসবেরির মতে, যে অর্থে আইন কথাটি প্রযুক্ত হয়, সেই অর্থে আন্তর্জাতিক আইনের কোন অস্তিত্ব দেখা যায় না। তাছাড়া রাষ্ট্র সার্বভৌমিকতা থাকার জন্য রাষ্ট্রের আইনের উপরে আইনকে আরোপ করা যায় না।

v)আইনের ব্যাখ্যাকর্তা হিসেবে বিচার বিভাগের অনস্তিত্ব:-রাষ্ট্রের আইন কে ব্যাখ্যা করার জন্য বিচার বিভাগের যে ভূমিকা দেখা যায়, আন্তর্জাতিক আইনের ক্ষেত্রে সেই ধরনের কোনো প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব নেই।

🕳️ আইন পদবাচ্য:-

ওপেনহাইম,পোলক,কেলসেন,লরেন্স প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী প্রদত্ত আন্তর্জাতিক আইনের ব্যক্ত মতবাদ নিম্নরূপ-

!) সদস্য রাষ্ট্রের স্বীকৃতি নির্ভর:-সাধারণ স্বীকৃতির উপর ভিত্তি করে যেভাবে আইন দাঁড়িয়ে থাকে আন্তর্জাতিক আইন ও ঠিক তাই। কারণ রাষ্ট্রগুলির প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে একে মেনে চলে। পারস্পরিক বিরোধের মীমাংসা, যুদ্ধ প্রতিরোধ প্রভৃতি সমস্যার আন্তর্জাতিক আইনের মাধ্যমে সমাধান করা হয়। রাষ্ট্রগুলির পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ধারণ আন্তর্জাতিক আইনের প্রয়োজন।

!!) উৎসগত দিক থেকে অভিন্ন:-জাতীয় আইন ও আন্তর্জাতিক আইনের উৎস অভিন্ন। প্রথা, চুক্তি, বিচারালয়ের রায়, পণ্ডিতদের আলোচনা প্রভৃতি আন্তর্জাতিক আইনের উৎস হিসেবে স্বীকৃত। এমনকি আন্তর্জাতিক আইনের ক্রমবিবর্তন দেখা যায়।

!!!)সমস্ত রাষ্ট্রের আনুগত্য:-আন্তর্জাতিক আইনকে অবলবৎযোগ্য বলা যায় না, সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের মত আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান এ জন্য অবিরাম কাজ করে চলেছে। নিরাপত্তা পরিষদ অতীতে ও বর্তমানে এই ধরনের বহু উদ্যোগ বাস্তবে কার্যকর করেছে। তা ছাড়া আর কোন রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক আইনকে অমান্য করার কথা ঘোষণা করতে পারবে না। আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি অশ্রদ্ধা ও আনুগত্যহীনতার পরিচয় কোন রাষ্ট্র দিতে চায় না।

 !v)আইন লঙ্ঘনের দোহাই যুক্তিহীন:-আন্তর্জাতিক আইনকে লঙ্ঘন করা যায়, তাই তা আইন নয়-এই যুক্তিও ঠিক নয় বলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা অভিমত প্রকাশ করেন। সাম্রাজ্যবাদী ও যুদ্ধবাজ রাষ্ট্র কোন কোন ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক আইন ভাঙলেও এর গুরুত্ব কমে যায় না। কারণ কিছু সমাজবিরোধী আন্তর্জাতিক আইনের মতো জাতীয় আইনও লংঘন করে। তা সত্ত্বেও জাতীয় আইন কি আইন বলে যদি গণ্য করা হয়, তাহলে আন্তর্জাতিক আইন ও আইন পদবাচ্য হওয়া উচিত।

 v)বিশ্বজনমত:- জাতীয় আইন যে কেবলমাত্র শাস্তির ভয়ে মানা হয়না তা কিন্তু নয়। এর পিছনে জনমত ও জনসচেতনাও কাজ করে। অনুরূপভাবে, আন্তর্জাতিক আইনের ক্ষেত্রেও রয়েছে সদা জাগ্রত বিশ্ববিবেক ও বিশ্বজনমত। সেক্ষেত্রে কোন রাষ্ট্র এর গুরুত্বকে অস্বীকার করতে পারে না।

উপসংহার:- বর্তমানে আন্তর্জাতিক আইনবিদরা আন্তর্জাতিক আইনকে প্রকৃত আইনের মর্যাদা দেয়ার পক্ষপাতী। ওপেনহাইম এবং হলের মতো আইনজ্ঞরা আন্তর্জাতিক আইনের পক্ষে বিশ্বজনমত গড়ে তুলেছেন। সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের আন্তর্জাতিক বিচারালয়ের অধীনে এই আইন প্রকৃত আইনের সব বৈশিষ্ট্য অর্জন করতে পেরেছে। একথা অনস্বীকার্য যে, অস্পষ্টতা ও দুর্বলতা থাকায় এখনো এর স্থান প্রাথমিক পর্যায়েই।


No comments: