7.
জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের ধারণা
জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের ধারণা ছিল সম্পূর্ণ নিজস্ব। তাঁর জাতীয়তাবাদী ভাবনা একদিকে যেমন স্বদেশি চেতনার সীমিত গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না,
অন্যদিকে তেমনই ইউরােপীয় জাতীয়তাবােধের অহমিকার দ্বারাও প্রভাবিত ছিল না। জাতীয়তাবাদ বিষয়টিকে রবীন্দ্রনাথ বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে দেখতে চেয়েছিলেন যেখানে কোনােরকম সংকীর্ণতার স্থান নেই।
[1] ইউরােপীয় জাতীয়তাবাদের সমালােচনা: রবীন্দ্রনাথ তাঁর ন্যাশনালিজম (Nationalism) গ্রন্থে জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে নিজের মৌলিক চিন্তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেন। ১৯১৬-১৭ সালে জাপান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণের সময় বিভিন্ন জায়গায় তিনি যেসব বক্তৃতা দেন, সেগুলি নিয়েই তার ন্যাশনালিজম গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ জাতীয়তাবাদ, বিশেষত ইউরোপীয় জাতীয়তাবাদের তীব্র সমালােচনা করেন। পাশ্চাত্যের মাটিতে যে জাতীয়তাবাদের জন্ম তাকে তিনি ভাল চোখে দেখেননি। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, ইউরোপীয় জাতীয়তাবাদ শুধু ঘৃণা, বিদ্বেষ, বিরোধ আর বিচ্ছেদের জন্ম দেয়। এই জাতীয়তাবাদ ধর্ম, মানবতাবাদ, নীতিবোধ ও মূল্যবোধের উপর প্রতিষ্ঠিত নয়। এইজন্য পশ্চিমের দেশগুলোতে মারামারি হানাহানি নিরন্তর ঘটে চলেছে। নিজের দেশ নিজের জাতি বড় আর অন্য সব দেশ অন্য সব জাতি ছোট ও নিচ-জাতীয়তাবাদের এই ধারণা যে বিভেদের বীজ বপন করে তা ক্রমশ উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের জন্ম দেয়। শেষ পর্যন্ত তার দুর্বল রাষ্ট্রগুলিকে গ্রাস করে নেয় এবং বিশ্বে অধিপত্য কায়েমের সচেষ্ট হয় তাই রবীন্দ্রনাথ পশ্চিমী জাতীয়তাবাদকে আধিপত্যবাদ বা প্রভুত্ববাদ বলে অভিহিত করেছেন।
2] পাশ্চাত্য সভ্যতা ও জাতীয়তাবাদ: রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন যে, ইউরােপ তথা পশ্চিমের যন্ত্রনির্ভর সভ্যতার মূল চালিকাশক্তি হল জাতীয়তাবাদ। পাশ্চাত্য সভ্যতার জাতীয়তাবাদ সমগ্র মানবজাতি এবং সমগ্র মানবসভ্যতার পক্ষে এক ভয়াবহ বিপদ। জীবনের অন্তিম লগ্নে সভ্যতার সংকট প্রবন্ধের গভীর দুঃখ ও ক্ষোভের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন পাশ্চাত্য জাতির সভ্যতা অভিমানের প্রতি শ্রদ্ধা রাখা অসাধ্য হয়েছে।সে তার শক্তিরূপ দেখিয়েছে কিন্তু মুক্তিরূপ দেখাতে পারেনি।শুরুতে ইউরোপ কে মন থেকে বিশ্বাস করলেও শেষে দেউলিয়া করে গিয়েছিল।
[3] জাতি ও জাতীয়তাবাদ: রবীন্দ্রনাথ তাঁর শিক্ষার মিলন প্রবন্ধে এ কথা স্পষ্টভাবে বলেছেন যে, জাতি (nation) গঠিত হয়েছে সত্যের জোরে কিন্তু জাতীয়তাবাদ (Nationalism) সত্য নয়। জাতীয়তাবাদ এমন এক ধরনের দুর্বুদ্ধিসম্পন্ন মানসিকতা যেখানে দেশের আত্মস্তরিতা প্রকাশ পায়। এ এমন এক রিপু যেখানে সকলের দিকে নয়, নিজের দিকে টান বেশি থাকে।
[4] জাতির চেয়ে মানুষ বড়াে: মানবতাবাদী রবীন্দ্রনাথের কাছে জাতির চেয়ে মানুষই ছিল বড়াে। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন যে, জাতীয়তাবাদের প্রভাবে মানুষের মধ্যে যে বিচ্ছিন্নতার সৃষ্টি হয়, তাতে মনুষ্যত্বের অবক্ষয় ঘটে জাতীয়তাবাদী ধারণার মানুষকে বলি দেয়। এখানে মানুষের সৃজনশীল সত্তার স্বাধীন বিকাশ ঘটে না। ব্যক্তি মানুষ নেশন এর অধীনে যন্ত্রে পরিণত হয়। জাতীয়তাবাদের জাতীয় গরিমার যে আবেগ মানুষের মনে বিভেদ সৃষ্টি করে, তা ক্রমশ মানুষকে দানবে পরিণত করে। মানুষের যাবতীয় শুভ চিন্তা, শুভ চেতনা সব ধ্বংস হয়ে যায়। এইভাবে জাতীয়তাবাদ মানবসভ্যতার শংকট ডেকে আনে।
[5] ভারতীয় জাতীয়তাবাদ: রবীন্দ্রনাথ সতর্ক করে দিয়ে বলেছিলেন, পশ্চিমি জাতীয়তাবাদ—পশ্চিমি সভ্যতার এই পথ কখনােই ভারতবর্ষের পথ হতে পারে না| ভারত কখনও পাশ্চাত্যের ধারণায় নেশন বা জাতি ছিল না। ভারতের জাতি সম্পর্কিত সমস্যা থাকলেও তা রাষ্ট্রশক্তির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ছিল না।ভারতের সামাজিক ব্যবস্থা তাকে নিয়ন্ত্রণে রেখেছিল।তাই নানা যোদ্ধা জাতি ভারতে এসেছে কিন্তু তারা কেউ ভারতের সমাজব্যবস্থাকে স্পর্শ করতে পারেনি।
উপসংহার:- সমকালীন পৃথিবীর যে সময় উগ্র জাতীয়তাবাদের উন্মাদনায় উপনিবেশবাদী সাম্রাজ্যেবাদের কামনায় মেতে উঠেছিল, সেইসময় রবীন্দ্রনাথ সমগ্ৰ মানবজাতির ঐক্যচেতনার কথা ভেবেছিলেন। তাঁর লক্ষ্য ছিল, মানবজাতির আত্মিক সৌহার্দ্য ও ভ্রাতৃত্বের মেলবন্ধন।
No comments:
Post a Comment