Friday, September 17, 2021

অধিকারের সংজ্ঞা ও প্রকৃতি বিশ্লেষণ করো। অধিকার সম্পর্কে মার্কসীয় ধারনা কি?

6.

⭕অধিকারের সংজ্ঞা:- হ্যারল্ড লাস্কির মতে, অধিকার হলো সমাজ জীবনের সেই সব সুযোগ-সুবিধা যেগুলি ছাড়া কোন ব্যক্তি সাধারণভাবে তার ব্যক্তিত্বের প্রকৃষ্টতম বিকাশ ঘটাতে পারে না।

বার্কারের মতে, সবচেয়ে অধিক সংখ্যক লোকের সর্বাধিক বিকাশসাধনের।। জন্য যেসব সুযোগ-সুবিধা বা শর্ত আইন কর্তৃক স্বীকৃত ও সংরক্ষিত হয় তাকে অধিকার বলে। বার্কারের বিশ্লেষণ অনুযায়ী দুটি শর্ত পূরণ করলে কোনো সুযোগ-সুবিধা কে অধিকার বলে অভিহিত করা যেতে পারে-

1) সুযোগ সুবিধাগুলি প্রত্যেকের ব্যক্তিত্ব বিকাশের সহায়ক হবে এবং

 2)সুযোগ সুবিধাগুলি রাষ্ট্রকর্তৃক স্বীকৃত ও সংরক্ষিত হবে।

⭕অধিকারের প্রকৃতি:- অধিকার এর প্রকৃতি বিশ্লেষণে বলা যায় যে,

1) শুধুমাত্র সমাজবদ্ধ জীব হিসেবে ব্যক্তি অধিকার ভোগ করতে পারে। মানব সমাজের বাইরে অধিকারের কোন কর্তৃত্ব নেই। 

2)অধিকারের একটি আইনগত দিক আছে। রাষ্ট্র আইনের মাধ্যমে অধিকারকে স্বীকৃতি দেয় ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে।

3) সমাজের সমস্ত মানুষের ব্যক্তিত্ব বিকাশের জন্য অধিকার অপরিহার্য।

4) সমাজকল্যাণের সঙ্গে অধিকারের ধারণা জড়িত থাকে। বস্তুত, অধিকার সামাজিক স্বার্থের বিরোধী হওয়া উচিত নয়।

5) সমাজ ও সভ্যতার ক্রমবিবর্তনের সঙ্গে অধিকার পরিবর্তিত হয়।

6) অধিকারের সঙ্গে কর্তব্য সম্পাদনের বিষয়টি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। কর্তব্য পালন না করলে অধিকার ভোগ করা যায় না।

আবার প্রকৃতিগতভাবে অধিকার কে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়। এর মধ্যে একটি হলো নৈতিক অধিকার ও অপরটি হল আইনগত অধিকার।

🔺!) নৈতিক অধিকার:- যে সমস্ত অধিকার সামাজিক ন্যায়-নীতি বোধের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে, তাদের নৈতিক অধিকার বলা হয়। প্রসঙ্গত, নৈতিক অধিকার ভঙ্গ করলে রাষ্ট্র কোন শাস্তি দিতে পারেনা। নৈতিক অধিকার রাষ্ট্রের দ্বারা স্বীকৃত এবং সংরক্ষিত নয়।

🔺!!)আইনগত অধিকার:-আইনের মাধ্যমে শিক্ষিত হোক এবং সংরক্ষিত হয় যে সমস্ত অধিকার, তাদের আইনগত অধিকার বলে। এই অধিকার ভঙ্গ করলে রাষ্ট্র শাস্তি দিতে পারে। যেমন ভোটদান করার অধিকার একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক অধিকার। এই অধিকারে কেউ হস্তক্ষেপ করলে রাষ্ট্র তাকে শাস্তি দিতে পারে। আইনগত অধিকার কে চারটি ভাগে ভাগ করা যায়। সেগুলি হল-

!)পৌর অধিকার,

!!)রাজনৈতিক অধিকার,

!!!)অর্থনৈতিক অধিকার, 

!v)সামাজিক ও কৃষ্টিগত অধিকার।

⭕অধিকার সম্পর্কে মার্কসীয় ধারনা:-মার্কসীয় মতবাদ অনুযায়ী, অধিকার সমাজচরিত্রের অর্থনৈতিক বিন্যাসের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে গড়ে ওঠে। মানুষের অধিকারের প্রকৃতি উৎপাদন পদ্ধতির সঙ্গে তার সম্পর্কের ভিত্তিতে নির্ধারিত হয়। বৈষম্যমূলক সমাজে অধিকার হলো উৎপাদন ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণকারী মালিক শ্রেণীর অধিকার। একমাত্র শোষনহীন সমাজতান্ত্রিক সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের অধিকার রক্ষা সম্ভব হয়।

#অধিকারের রূপগুলি আলোচনা করো।

 5.

অধিকারের রূপভেদ

প্রকৃতিগতভাবে অধিকারকে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়। যথা- 1)নৈতিক অধিকার ও 2)আইনগত অধিকার।

1)নৈতিক অধিকার:- যেসব অধিকার সামাজিক ন‍্যয়নীতিবোধের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে, তাদের নৈতিক অধিকার বলা হয়।তবে নৈতিক অধিকার রাষ্ট্রীয় আইনের দ্বারা স্বীকৃত এবং সংরক্ষিত নয়।

2) আইনগত অধিকার:- যেসব অধিকার রাষ্ট্রীয় আইনের দ্বারা স্বীকৃত এবং সংরক্ষিত , সেগুলিকে আইনগত অধিকার বলে‌।‌

এই আইনগত অধিকার চার প্রকারের।ঐ চার প্রকার অধিকার নম্নে আলোচিত হল-

1) পৌর অধিকার:- সুযোগ-সুবিধাযুক্ত মানুষের সুস্হ সামাজিক জীবন-যাপনই হল পৌর অধিকার।

মানুষের বাঁচার জন‍্য আত্মরক্ষা ও আত্মরক্ষার তাগিদেই বলপ্রয়োগের অধিকার এবং এই আত্মরক্ষার জন‍্যই সবাইয়ের প্রয়োজন ব‍্যক্তি স্বাধীনতার অধিকার যেখানে সে তার চিন্তা ও মতপ্রকাশে স্বাধীনতা, সমিতি গঠন,বৃত্তি অবলম্বন, বসবাস, সভাসমাবেশে যোগদান, বিনা বিচারে গ্রেফতার বা আটক না হওয়া। সম্পত্তির ভোগ-দখল,ক্রয়বিক্রয়ের জন‍্য সম্পত্তির অধিকার। ধর্মীয় বিশ্বাস, আচার-আচরণ ও প্রচার ও ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র গঠনে হস্তক্ষেপ না করা। শিক্ষার সুযোগ সুবিধা পাওয়া, সুখী ও সমৃদ্ধ পরিবার গঠন,ব‍্যবসা-বাণিজ্য এবং অন‍্য যে কোন বিষয়ে যে কোন ব‍্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তিতে আবদ্ধ হওয়াই হল পৌর অধিকার।

2)রাজনৈতিক অধিকার:- রাষ্ট্রের কাজকর্মে নাগরিকদের প্রত‍্যক্ষ ও পরোক্ষ অংশগ্রহণের পূর্ণ সুযোগ সুবিধা হল রাজনৈতিক অধিকার।

আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সার্বিক প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকার হল রাজনৈতিক অধিকারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধিকার যেখানে স্ত্রী-পুরুষ জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিটি নাগরিক ভোট দিতে সক্ষম সাথে সাথে নাগরিকরা নির্বাচনে নির্বাচিত হওয়ার অধিকার অনুযায়ী প্রার্থীও হতে পারবে। অন্যদিকে প্রতিটি নাগরিক সরকারি চাকরির আবেদন পত্র বিভিন্ন রকম রাষ্ট্রের সমালোচনার অধিকারীও হওয়ার পাশাপাশি জনস্বার্থ রক্ষায় সৌরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধও করতে পারবে।

3)অর্থনৈতিক অধিকার:- দৈনন্দিন জীবনকে নিরাপদ ও স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ করে তোলা এবং দারিদ্র্য ও অনিশ্চয়তা দূরীকরণই হল অর্থনৈতিক অধিকার।

অর্থনৈতিক অধিকার অর্থাৎ আয়ের জন্য অধিকার, যেখানে প্রত্যেক ব্যক্তির যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ পাওয়া প্রাপ্ত বয়স্ক নাগরিকদের যোগ্যতা অনুসারে উপযুক্ত কাজ পেতে সাহায্য করা রাষ্ট্রের কর্তব্য আবার কাজের সাথে সাথে উপযুক্ত পারিশ্রমিক পাওয়া ও তাদের অধিকারের মধ্যে পড়ে সেখানে কাজের জন্য সময় নির্ধারণ করা এবং বার্ধক্যে যখন সে অক্ষম হয়ে পড়ে তখন তার প্রতি নিরাপত্তা প্রদান করা প্রকৃতি ও অর্থনৈতিক অধিকারের মধ্যে পড়ে।

4)সামাজিক ও কৃষ্টিগত অধিকার:- সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে এবং সমাজের আচার-অনুষ্ঠান সুষ্ঠুভাবে  পরিচালনা করতে মানুষের অপরিহার্য অধিকারটি হল সামাজিক ও কৃষ্ঠিগত অধিকার।

স্ত্রী-পুরুষ ধর্ম-বর্ণ-জাতি নির্বিশেষে রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা ও উন্নয়নে সামাজিক সাম্যের অধিকারের পাশাপাশি জীবন যাপনের জন্য সুস্থ জীবন যাপনের অধিকার স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য স্বাস্থ্য রক্ষার অধিকার এবং অতিরিক্ত কাজ করিয়ে বেশি শুসিত না হওয়ার জন্য শোষণমুক্তির অধিকার এছাড়া প্রতিটি ব্যক্তির নিজস্ব ভাষা সংস্কৃতির ও প্রতিটি সম্প্রদায়ের ভাষা সংস্কৃতি বিকশিত হওয়ার জন্য ভাষা ও সংস্কৃতির অধিকার, সামাজিক ও কৃষ্টি গত অধিকারকে এক বিশেষ অবদান রাখে।

মানবাধিকারের সংজ্ঞা দাও। জাতিপুঞ্জের ঘোষণাপত্রে বিবৃত মানবাধিকার গুলি উল্লেখ করো

 4.

মানবাধিকারের সংজ্ঞা



বর্তমান বিশ্বে বিশেষভাবে আলােচিত সমালােচিত বিষয় হল মানবাধিকার (Human Rights) সাধারণভাবে মানবাধিকার বলতে মানুষের ব্যক্তিত্ব বিকাশের জন্য অপরিহার্য অধিকারগুলিকে বােঝায়

মানবাধিকার হল মানুষের অধিকার, যা জাতি-ধর্মবর্ণ-স্ত্রী-পুরুষ ধনী দরিদ্র নির্বিশেষে সকলের ক্ষেত্রে প্রযােজ্য। মানুষ বা মানবিক সত্তার অস্তিত্ব রক্ষা কল্যাণসাধন এবং মানুষের মর্যাদা তার মনুষ্যসত্তার প্রতি শ্রদ্ধা সম্মান দেখানাের সঙ্গে মানবাধিকার সম্পর্কিত। শুধুমাত্র মানবসমাজের সদস্য হিসেবেই প্রতিটি মানুষের ন্যূনতম কিছু অধিকার ভােগ আবশ্যিক। এই ন্যূনতম অধিকারই হল মানবাধিকার



আন্তর্জাতিক সনদ অনুযায়ী মানবাধিকার বলতে সংবিধানগতভাবে সকলের আত্মমর্যাদা নিয়ে জীবনধারণের অধিকার, স্বাধীনভাবে বাঁচার অধিকার এবং সকলের সমানাধিকারকে বােঝায়। আন্তর্জাতিক বিচারালয়ের মাননীয় বিচারপতি নগেন্দ্র সিংহ বলেন, বিশ্বের যেকোনাে অংশে বসবাসকারী প্রতিটি পুরুষ অথবা নারী একজন মানুষ হিসেবে যেসব মৌলিক অধিকার ভােগ করতে পারে, সেগুলিকে মানবাধিকার বলে। ভারত সরকার প্রণীত 'মানবাধিকার রক্ষা আইন' (The Protection of Human Right Act, 1993)- বলা হয়েছে, "মানবাধিকার হল ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, সাম্য মর্যাদা সংক্রান্ত সেইসব অধিকার, যেগুলি সংবিধান কর্তৃক স্বীকৃত অথবা আন্তর্জাতিক চুক্তিপত্রের অঙ্গীভূত এবং ভারতের আদালত কর্তৃক বলবৎযােগ্য।"



মানবাধিকার সম্পর্কিত ধারণার ইতিহাস বহু প্রাচীন। বস্তুত, অতি প্রাচীন প্রাকৃতিক অধিকার থেকে মানবাধিকারের সূচনা। তবে .নিঃসন্দেহে, ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের ১০ ডিসেম্বর সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের সাধারণ সভায় গৃহীত বিখ্যাত মানবাধিকার সম্পর্কিত বিশ্বজনীন ঘােষণাপত্র মানবাধিকারের ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তরফলক। এই ঘােষণাপত্রের ৩০টি ধারায় মানবিক বিকাশের জন্য প্রয়ােজনীয় পৌর, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সাংস্কৃতিক অধিকার স্থান পেয়েছে। জাতিধর্মবর্ণনির্বিশেষে বৈষম্য ছাড়াই বিশ্বের যে-কোনাে অংশের মানুষ ওই অধিকার স্বাধীনতা ভােগ করতে পারে। মানবাধিকার সংক্রান্ত ঘােষণাপত্রের প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে—“মানব পরিবারের সকল সদস্যের সহজাত মর্যাদা এবং অভিন্ন অপরিহার্য অধিকারের স্বীকৃতি হল স্বাধীনতা, ন্যায়বিচার এবং বিশ্বশান্তির মূলভিত্তি



জাতিপুঞ্জের ঘােষণাপত্রে বিবৃত মানবাধিকারসমূহ



সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের মানবাধিকার সংক্রান্ত বিশ্বজনীন ঘােষণাপত্রে মােট ৩০টি অনুচ্ছেদে মানবাধিকারের কথা বলা হয়েছে। মূলত ব্যক্তির পৌর রাজনৈতিক অধিকারের কথা বলা হয়েছে। প্রথম অংশে রয়েছে। (প্রথম ২১টি অনুচ্ছেদ)

·         [1] জীবন, স্বাধীনতা ব্যক্তিগত নিরাপত্তার অধিকার

·         [2] দাসত্ব অত্যাচার থেকে মুক্তি

·         [3] আইনের চোখে সমানাধিকার

·         [4] চিন্তা-বিবেকধর্ম-মতামত বক্তব্য প্রকাশের মৌলিক অধিকার

·         [5] যথেচ্ছ গ্রেফতার থেকে অব্যাহতি লাভের অধিকার ইত্যাদি



দ্বিতীয় অংশে অর্থনৈতিক, সামাজিক সাংস্কৃতিক অধিকারের উল্লেখ রয়েছে

·         [1] কাজ করার পাওয়ার অধিকার

·         [2] সমান কাজের জন্য সমান মজুরি পাওয়ার অধিকার

·         [3] ভদ্রস্থ জীবনযাপনের অধিকার,

·         [4] শিক্ষার অধিকার ইত্যাদি



ছাড়া মানবাধিকার সংক্রান্ত জাতিপুঞ্জের কিছু আন্তর্জাতিক দলিলও রয়েছে। এইসব দলিলে লিপিবদ্ধ অধিকারের মধ্যে রয়েছে। বাঁচার অধিকার, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষের মৌল অধিকার, যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ শরণার্থীদের মানবিক অধিকার, শিশুদের অধিকার, আদিবাসীদের মৌলিক অধিকার ইত্যাদি